top of page

অচিন পুরীর গপ্প - চতুর্থ পর্ব, খাজার খোজে



চতুর্থ পর্ব

আজ সারাদিন নির্ভেজাল ল্যাদ খাওয়ার পরিকল্পনা আছে আমাদের। গতকাল রঘুরাজপুর ঘুরে স্বভাবতই আমি খুব খুশি, লেখার অনেক মাল মসলা মজুদ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সকাল সকাল বাইক নিয়ে চক্কর মারতে মারতে স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেলাম। কি আশ্চর্য সকাল সকাল রসগোল্লাও বিক্রি হচ্ছে এখানে।


ভোর সাড়ে ছটায় রসগোল্লা

এই সেই লাইট হাউস, ছোটবেলার কত স্মৃতি। অভাবের টানাটানির সংসারে স্বর্গদ্বারের কাছাকাছি ঝাঁ-চকচকে হোটেল গুলোতে কখনো থাকা হয়নি। কিন্তু ব্রাহ্মণ থেকে ভিখারী- পুরী তো সবার, তাই না?


শৈশব থেকে চিনে আসা পুরীর লাইট হাউস

আমাদের ঠাই হত লাইট হাউজ এর পিছনে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা সস্তার হলিডে হোম গুলোতে। সেগুলো অনেক ভিতরে, তাই সমুদ্রের অবিরাম বাতাস বারান্দায় এসে পৌঁছালেও সমুদ্রকে কখনোই দেখা যেত না। ঠিক সেই কারনেই সমুদ্রের ধারে আসলেই রাস্তায় দাড়িয়ে নজর যেত নীল কাঁচের জানালায় লুকিয়ে রাখা সমুদ্রমূখী বিলাসবহুল ঘর গুলোর দিকে। সেই সব গত জন্মের কথা, এই জন্মে আড়াই বছর আন্দামানে থেকে ঘরে বসে সমুদ্র দেখার বাসনা আর নেই। সবকিছু আগের মতোই আছে, কিন্তু বদলেছে আমার পছন্দ।


সকালে তোলা কিছু এলোমেলো ছবি


এর মধ্যেই ঝিনুকের ফোন, ঠিক ধরে ফেলেছে আমি নিরুদ্দেশ। আসলে সকালে যখন বেরোচ্ছি তখন সে ঘুমোচ্ছে, তাই খামোখা আর বিরক্ত করিনি। কিন্তু সেসব অজুহাত এখন চলবে না, কুরুক্ষেত্র লেগে যাবে- মানে মানে ফিরে যাওয়াই ভালো।


আজকের প্রধান অনুষ্ঠান সমুদ্র স্নান, তবে তার আগে সারতে হবে প্রাতরাশ। মনে হল পাশেই তো বেহেরা সুইটস- বাইক নিয়ে এক ছুটে কিনে আনলেই হয় কয়েক পিস খাজা, সুনীলের হাতের পরোটা ও আলুর তরকারির সাথে ব্যাপারটা বেশ জমে যাবে। যেমন কথা তেমনি কাজ। হাফ প্যান্ট পড়ে চললাম আমাদের বাঁধাধরা খাজার দোকান বেহারা সুইটস এর দিকে। এত বছরেও একই রকম আছে জায়গাটা, সেই একই স্বাদ, একই দোকান, একই মালিক। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম "আমরা আপনার খুব ছোট খদ্দের, কিন্তু নিয়মিত খদ্দের"। আশ্চর্য ব্যাপার, খাজার মূল্যও একই রকম আছে- সাধারণ মানের খাজা ১৩০ টাকা, আরেকটু ভালো মানের দেড়শ টাকা, শুদ্ধ ঘিয়ে ভাজা অগ্রিম অর্ডার দিয়ে বানালে ১৬০ টাকা প্রতি কেজি। স্বর্গদ্বারের ঝা চকচকে দোকান গুলি সেখানে পর্যটক এর সংখ্যা বেশি হওয়ার দরুন নামেই কাটে। হলফ করে বলতে পারি বেহারা সুইটস এর দাম এবং মান পুরীর অন্যান্য যে কোন দোকানকে টেক্কা দিতে পারে।


বেহেরা সুটস্

মালিক আজ নেই, আছে তার ছেলে। তার সাথেই খোশমেজাজে আড্ডা হল কিছুক্ষণ। হঠাৎ কি মনে হলো জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা দাদা আমাকে একবার আপনাদের কারখানায় নিয়ে যাবেন? আমি খাজা বানানো দেখব”।

“কেন আপনার কি দোকান আছে? আপনি কি খাজা বিক্রি করতে চান।”

“আরে না না দোকান নয়। আমি শুধু কটা ছবি তুলতে চাই, ভিডিও করতে চাই। আসলে পুরীর এই অন্যতম আকর্ষণীয় জিনিসটি; যা আমরা প্রত্যেকে উপভোগ করেছি, সেটা কিভাবে বানানো হয় কোনদিনও দেখিনি- কেউ দেখেছে বলেও শুনিনি তাই ভাবছিলুম।”

ভদ্রলোক খুব একটা রাজি তো হলেনই না অত্যন্ত বিরক্তির সাথে বললেন “বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, উনি দুপুরবেলা বসেন।” মানে একেবারে নাকচ করলেন না, সেটাই আশার কথা। ঠিক আছে, আসুক তোমার বাবা, আমি আসবো দুপুরবেলা অনুমতি নিতে।

সকালের স্নান পর্ব ভালোমতোই সারলো। ছোটু অবশ্য একটু ভয়ই পেয়েছিল মনে হয়। কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে, তোয়ালে দিয়ে ঘোমটা জড়িয়ে বসে পরল দাদুর কোলে। তবে হাম্পি নাছোড়বান্দা, যতবার জল থেকে তুলি খালি বলে “আবাদ যাবো”। একবার করে জলে চুবাই, পরক্ষণেই মাথা উচিয়ে সে কি হাসি। ছোট্ট শরীরটার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে যে এত তেজ তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।



পুত্রদের সাথে প্রথম সমুদ্রে স্নান

স্নান পর্বের ভিডিও

https://youtu.be/PJBvelT6LcE


দুপুরে সরষে বাটা দিয়ে পার্সে মাছের ঝোল, সুনীল বাবুর আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। তারপর ভাতঘুম উপেক্ষা করে কাঠফাটা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে আবার রওনা হলাম বেহরা সুইটস এর উদ্দেশ্যে। কি যে বলব ভদ্রলোককে? কেনই বা সে আমাকে অনুমতি দেবে তার কারখানায় যাবার। হতেই তো পারে আমি তার প্রতিযোগীদের মধ্যে একজন- এই ঝুঁকি কেউ নেয়।

পর্যটকদের ভিড় নাইবা থাকুক, দোকান সব সময় চালু। এলাকার মানুষের আনাগোনা কেনাকাটা লেগেই রয়েছে। মালিক গম্ভীর মুখে বসে রয়েছেন দোকানে, কেনাকাটার হিসেব রাখছেন। সোজা গেলাম তার কাছে। কিরকম একটা উত্তেজনা অনুভব করছি।হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল,


মালিক শ্রী বাসুদেব বেহেরা

“সকালে আপনার ছেলের সাথে কথা হয়েছে আমার, দশ বারো কেজি স্পেশাল খাজা লাগবে ঘিয়ে ভাজা”

“কবে লাগবে?”

“কাল”

“ঠিক আছে এই সময় চলে আসবেন পেয়ে যাবেন। কটায় গাড়ি আপনাদের?”

“গাড়ি রাত্রে।”

“সমস্যা নেই হয়ে যাবে।”

“না মানে ইয়ে, আমার একটা অনুরোধ ছিল।”

“হ্যাঁ, বলুন।”

“আমি একটু খাজা বানানো দেখতে চাই।”

যেইনা বলা ভুরু কুঁচকে চোখ দুটো ছোট করে আমায় মাপতে লাগলেন-

এবার ওনার চোখ পরল আমার কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরার ব্যাগ টার দিকে-

আপনি কি মিডিয়ার লোক?

না মিডিয়া নয় তবে আমার নিজস্ব একটা ওয়েবসাইট আছে, সেখানে আমি আমার ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা, বিভিন্ন জায়গার মানুষের কথা লিখে থাকি। দেখবেন?

কই দেখি?

অগত্যা মোবাইলে আমার ওয়েব সাইটের কিছুক্ষণ ডেমো দিলাম। কি বুঝলেন জানি না। বাংলা ভাষা বোঝার কথা নয় আর ইংরেজিতে উনি কতটা সড়গড় সেটা আমার অজানা।

তবে হ্যাঁ ছবিগুলো দেখে খুশি হলেন বলেই মনে হল। খাতা পেন বের করে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদা আপনার নামটা যদি একটু বলেন।”

“ও দাদা আপনি আমায় কোন বিপদে ফেলবেন না তো?”

“আরে না না বিপদে ফেলবো কেন? বেহারা সুইটস এর মালিকের নাম লোকজন জানুক- আমি শুধু সেটুকুই চাই।”

“আমারও নামটা... বাসুদেব বেহেরা অছি।”

“এ দোকান পঞ্চাশ বছর পুরনো অছি। আপোনার কোনো কার্ড অছি?”

কার্ড আছে কিন্তু সে তো বাঙ্কের ভিসিটিং কার্ড, তাই দিলাম ধরিয়ে, যা বোঝার বুঝে নে।

“অরেএএএ! সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক, মোর অকাউন্ট অছি সেখানে”।

এই রে কেলো করেছে, এবার না জানি কি কি অভিযোগের ডালা খুলে বসবে।

কিন্তু না, ভদ্রলোক আমাদের অনেক পুরনো খদ্দের, ঋন নিয়ে ব্যবসা করছেন আজ বহুবছর হলো। ব্যাঙ্ক এবং তার আধিকারিকদের প্রতি অগাধ আস্থা ও সম্মান। যাক তাহলে কিছু জায়গায় সরকারি ব্যাঙ্কেও কাজ হয়।

আলাপ জমছে, বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনাটা ক্রমশঃ আমার চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে।

“তা চলে আসুন কালকে সাড়ে বারোটা নাগাদ আমার কর্মচারীরা থাকবে দেখিয়ে দেবে, তবে একটা কথা বলে দিই রোজ যে কাজ হবে তার কিন্তু কোন মানে নেই। কারিগরের খুব সমস্যা বুঝলেন তো? আপনাদের কলকাতার কারিগরও আসে আমাদের কাছে। তবে দু তিন মাসের বেশি কেউই থাকেনা। দেখুন কাল যদি কাজ হয়।”

অনেক ধন্যবাদ আমি কাল আসব আপনার ফোন নম্বরটা যদি একবার দেন তাহলে ফোন করে আসবো।ভদ্রলোক তার ভিজিটিং কার্ডখানি বাড়িয়ে দিলেন।


জিভে জ্বল আনা বেহেরা সুটস-এর মিষ্টান্ন


ঘরে ফেরার আগে ভাবলাম একবার মন্দির চত্বরটা ঘুরেই আসি । বাইক যখন আছেই , কতক্ষনই বা লাগবে। অলি গলি ঘুরে গিয়ে পৌছলাম মন্দিরের রাজপথে। এমন নদীর মতন চওড়া রাস্তা ভারতের অন্য কোথাও আছে বলে জানা নেই। যতবার গিয়ে উঠেছি মনের ভিতর একটা অদ্ভুত ভয়মিশ্রিত ভালবাসা উপলব্ধি করি। এই রাজপথই প্রভুর মূর্তির একমাত্র বিচরণভূমি, নিরাকাররূপে তিনি রাজার মতন গোটা পৃথিবী ঘুরে বেরান ঠিকই। কিন্তু জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অগুন্তি ভক্তদের দর্শনের উপায় এই একটাই। যাই হোক আজ আর মন্দির দর্শন নয়, উদ্দেশ্য ছবি। দর্শনের দিন মোবাইল, ক্যামেরা সব তো জমা থাকে। ছবি উঠবে কি করে? সোজা হাঁটা মারলাম মন্দিরের কার্যালয়ের দিকে, দেখি যদি অনুমতি মেলে। কর্তব্যরত রক্ষীদের কাছে অনুমতি না মিললেও মিলল একটা উপদেশ, মুল ফটকের বিপরীতেই আছে নাকি একটি গ্রন্থাগার। সে তো বুঝলাম, তা দিয়ে কি হবে? সেখানে গিয়ে অনুমতি চাইলেই মিলবে সেটির ছাদে যাবার ছাড়পত্র।সেখান থেকেই নাকি দেখা যায় গোটা মন্দির প্রাঙ্গণ। বাহ! তাই বা কম কি। দেখি গিয়ে কি বলে। ভাবতেও লজ্জা হয় এতবার পুরী গিয়েছি গ্রন্থাগারে যাওয়া তো দুরস্ত, হদিসই পাইনি কখনো । না জানি কত হীরে জহরত লুকিয়ে আছে সেখানে। ভাবতে ভাবতে চললাম সেদিকে। খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হল না, কিন্তু মুস্কিল হল সিংহদুয়ারটা বন্ধ। ওপরে বড় বড় হরফে সময় লেখা সকাল নটা থেকে একটা, বিকাল চারটে থেকে ছটা। ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রভু মুচকি হেসে বললেন “আসছে বছর আবার হবে”। আপনাদের কারও যদি গ্রন্থাগারটিতে যাবার অভিজ্ঞতা থাকে অনুগ্রহ করে ভাগ করে নেবেন। অধীর অপেক্ষায় রইলাম।

নিরুপায় হয়ে চতুর্দিকের ফটকগুলির কিছু বোকা বোকা ছবি তুললাম।


বাইরে থেকে মন্দির


দুপুরে তোলা কিছু ছবি


তার সাথে যোগ হল দোকানপাট, বিশেষ করে খাজার দোকান। যদি কাল কোন কারণে ভেস্তে যায় সবকিছু, তাহলে এগুলো দিয়েই চালাতে হবে।

ফিরে এসে ঝিনুককে বললাম ব্যাপারটা, আগামীকাল হয়তো একটা মিষ্টি অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চলেছি। ও বলল বাবাকে নিয়ে যেও, উনি এইসব খুব ভালোবাসেন।

সন্ধ্যাটা কাটলো সমুদ্রের ধারেই, চেষ্টা করলাম রাতের সমুদ্র ও আশেপাশের দোকান গুলি ক্যামেরাবন্দি করতে, নমুনা দেওয়া থাকছে ভালো-মন্দ আপনারাই বিচার করবেন।



চলবে...

অন্যান্য পর্ব

101 views
bottom of page