top of page

অচিন পুরীর গপ্প - দ্বিতীয় পর্ব

Updated: May 15, 2019


দ্বিতীয় পর্ব

মন্থর গতিতে ট্রেন পৌছালো শ্রীকাকুলাম, পেটের ছুঁচো গুলো আবার জেগে উঠেছে। বিস্কুট আর কেক খাইয়ে বেচারাদের কতক্ষণই বা ভুলিয়ে রাখা যায়। উপায় নেই, তাই কুমীর ডাঙা খেলতে আবার নামতে হল প্লাটফর্মে। এবারে কিন্তু খাসা ইডলি আর নারকলের চাটনি জুটল। তিরিশ টাকায় প্রাণ ভোরে খাও পাঁচটি ইডলি। ট্রেন ছাড়তেই গতকাল রাতের চিমসে-টা ধড়ফড় করে উঠলো। বিরিয়ানি নিম্নগামী হওয়ায় ভোর আটটায় বাবুর প্রাতরাশের কথা মনে পড়েছে। অসহায় দৃষ্টিতে চোখ রাখল ট্রেনের বাইরে নদীর মতো বয়ে যাওয়া প্লাটফর্মটার দিকে। এই রে ! বেটা লোলুপ দৃষ্টিতে এইবার আমার ইডলির দিকে তাকিয়ে। সটান মুখ ফিরিয়ে কাঁচের জানলার বাইরে বয়ে চলা ধানক্ষেত আর গাছপালায় মন দিলাম। দেখ কেমন লাগে? বড় মধুর এই প্রতিশোধ, নারকেলের চাটনিটা যেন একটু বেশিই মিষ্টি লাগছে এইবার।

খাওয়া শেষ হতে না হতেই ঝিনুকের ফোন। আমি ছাড়া বাকি পরিবার শালিমার থেকে স্পেশাল ট্রেনে আসছে। শুরু হল আমার যমজ পুত্রদের নামে ত্রিস্তরীয় নালিশ। ছেলেরা ঘুমনোর আগে কি করেছে, ঘুমনোর সময় কি করেছে এবং ঘুম থেকে উঠে কি করেছে। আমি আর কি বলবো, যত শুনছি গতকালের খুদে যাত্রীটির কথা মনে পরছে। সত্যি পৃথিবীটা কত ছোট।

এখন বেলা বারোটা। আমার থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পরে যাত্রা শুরু করে, আমি পৌছবার তিন ঘণ্টা আগে সবাই পৌছে গেছে- আমার এই ল্যাঙরা ঘোড়া এখনো হামাগুড়ি দিয়েই চলেছে। কেবল আঙ্গুলের জোরে www.airbnb.co.in থেকে আমার পত্নী একটি চমৎকার বাড়ির ব্যবস্থা করেছে। মানে এই কদিনের জন্য পুরো দোতলা বাড়িটাই আমাদের রাজপাট। ফোনে এবার শুরু হোল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। চার চারটে বড় বড় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর, প্রতি ঘরে বড় একটা Sony TV, তাছাড়া সোফা, সেন্টার টেবিল, চেঞ্জ রুম আর পেল্লাই পেল্লাই বাথরুম। বিদ্যুতের অভাবে ইনভার্টারেরও ব্যবস্থা আছে। মানে যারে কয় রাজকীয় বন্দোবস্ত।এত কিছু মাত্র ১৫৫০ টাকা প্রতি রুম প্রতি দিন। চাইলে নিজের চোখে দেখে নিন। নীচে ঠিকানা দিলাম।

https://www.airbnb.co.in/rooms/32436639?s=51




Puri Naidu's House
আমাদের ইন্দ্রপুরি তার সামনে আমার ভাড়া করা বাইক


বাহ! বেশ জম্পেস ব্যপার তো। পুরীতে এসে বাড়িতে থাকবো। সঙ্গে রাধুনি ফ্রী। তাহলে এটা কি নতুনত্বের প্রথম কিস্তি? হ্যাঁ, তা তো বটেই, হলিডে হোম প্রচুর আছে জানি, তাতে নিজেরা রান্না করে খেয়েওছি আগে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন। জানিনা আপনারা কি বলবেন?

“আরে আমি আসছি তো, এসেই না হয় দেখছি সব। এই ভাবে এতকিছু বললে আমার তো আর ভালো লাগছে না, তাই না”। বুঝিয়ে বললাম। সময়ের আগেই ট্রেন ঢুকে পড়লো স্টেশনে, বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম রোদের তেজ কাকে বলে।


পুরী স্টেশন

তবে সমুদ্রের অকৃপণ বাতাস অস্বস্তি অনেকটাই লাঘব করে দিচ্ছে। সারি সারি অটো আর রিকশার জমায়েত পেছনে ফেলে বাঁদিক ফিরে হেঁটে চললাম ঝিনুকের পাঠানো নকসা অনুসরণ করে। ঘড়ি ধরে ঠিক সাত মিনিট, অনায়াশে পৌছালাম মডেল বিচ লাগোয়া কৃষ্ণা ভিলার পাশে পেল্লাই এক অনামী বাড়ির সামনে। অত্যন্ত যত্নসহকারে বানানো এক ইন্দ্রপুরী, নীচে একটা ঘর, রান্নাঘর ও খাওয়ার জায়গা, উপরে তিন তিনটে বড় বড় কামরা। পিতা মাতা যথারীতি AC চালিয়ে, ঠ্যাঙ ছড়িয়ে দিবানিদ্রায় মগ্ন। তাদের একটা হাঁক দিয়ে চলে এলাম উপরে, আমার রাজপুত্রদের কাছে। সোনার কাঠি মাথার কাছে রেখে আপাতত তেনারাও ঘুমচ্ছেন। বত্রিশপাটি বের করে ঝিনুক স্বাগত জানালো। অনেকদিন পর দেখলে নিজের বউকেও যে পরমা সুন্দরী লাগে সে কথা অনস্বীকার্য।


Jhinuk at Puri
আমার কুরি বছরের সঙ্গিনি। ঝিনুক

আমার শ্বশুরমশাই পাশের ঘরে শুয়ে, সকলেই আমার অপেক্ষায়। বিমলাদি একছুটে নীচে গিয়ে সুনীলকে জানিয়ে এলো দুপুরের খাবার বাড়তে। স্নানের পর্ব শেষ, এবার পালা সুস্বাদু খাবারের। সুনীলের হাতের জাদুতে সাধারন ডাল ভাত আর পটলের তরকারি যেন অমৃতের রূপ ধারন করেছে। সুনীল এই বাড়ির অল ইন অয়ান। মিতভাষী লাজুক এই ওড়িয়া যুবক আদতে কোনারকের বাসিন্দা, পেটের টানে এখন পুরীই ওর কর্মস্থল। প্রায় সাত বছর কাজ করছে নাইডু পরিবারের অধীনে। পাশেই CESCর গেস্ট হাউস, এতদিন সেখানে ছিল। এই বাড়ি হবার পর থেকেই গত মাস দুই ধরে দায়িত্ব সামলাচ্ছে।

আঙ্গুল চাটতে চাটতে উপরে এসে দেখি হাম্পি ততক্ষণে উঠে পড়েছে, এক চোখ বন্ধ একচোখ খোলা সেই অবস্থায় আমায় দেখে ঠিক যেন ভূত দেখেছে মনে হল। হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে সোজা ঝুলে পড়ল গলায়। প্রায় তিন মাস বাদে বাপ ছেলের দেখা, বড়ই মধুর এই মিলন। তিড়িং বিড়িং করে শুরু হলো ঘুমানোর পরের দুষ্টুমি। এইবার ছোটুর পালা, আমাদের আওয়াজে সেও নড়েচড়ে উঠেছে। উত্তেজনার জোয়ারে গা ভাসিয়ে শুরু হলো তিন ইয়ারের মহামিলন পর্ব। নিষ্পাপ শিশুর শর্তহীন ভালবাসা মুহূর্তে দূর করে দিলো সারা রাতের ক্লান্তি। “বাবা আমি তেনে করে… কুুউউ করে এতেছি”। মাত্র একবছর বয়স থেকে ক্রমাগত ভ্রমনে অভ্যাস হওয়ায় দুটোই একেবারে বাউন্ডুলে তৈরি হয়েছে। বেড়াতে বেরোলেই সব ঠিক। ফেরত যেতে চাইলেই “নাআআ... আমি, বালি দাবো নাআআ”।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। এবার সমুদ্রের ধারে হাওয়া খাওয়ার পালা। ফটাফট সব তৈরি হয়ে নিলাম। আমায় আবার যেতে হবে একটা মোটরসাইকেল ভাড়া করতে, কারণ গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি মোটরসাইকেল না থাকলে ঠিক তৃপ্তি হয় না। আর বিশেষ করে যখন নতুন কিছুর সন্ধানে আমায় এদিক ওদিক যেতে হতেই পারে। বাকিরা তাই রওনা হল স্বর্গদ্বারের দিকে, আমি চললাম মোটরসাইকেলের খোঁজে। দিন প্রতি সাড়ে তিনশো টাকায় রফা হল।

যতক্ষণে তেল ভরিয়ে ফিরলাম ততক্ষনে আমার দুই পুত্র তাদের পাম্মিকে (ঠাম্মি) বাসুকি বানিয়ে সমুদ্র মন্থনে মেতে উঠেছে, পরের পর ধেয়ে আসা ঢেউগুলো তখন তাদের খেলার সঙ্গী। এত বিচিত্র, বিরাট চাঞ্চল্যকর জিনিস ওরা আগে কখনো দেখেনি। আপাদমস্তক ভিজে গায়ে বালি মেখে উঠেই বলে “আবাদ দাবো”। দুটোকে সামলাতে ঝিনুকের তখন নাজেহাল অবস্থা। কোন রকমে একটা একটা চ্যাংদোলা করে তুললাম। তাও থামে না, খালি বলে “আমাকে ছেয়ে দাও , আবাদ দাবো”।


সেই আনন্দের মুহূর্ত। ছবিতে, পুত্রদের চোখ স্বাভাবিক ভাবেই সমুদ্রের দিকে


আচ্ছা মুশকিল তো এই পড়ন্ত বেলায় এইভাবে কাক ভেজা ভিজলে আর রক্ষে আছে? আপনারাই বলুন। সব কিছুরই একটা সীমা আছে। এদিকে সীমাও তখন জলের মধ্যে। প্রসঙ্গত বলে রাখি সীমা ও বিমলাদি দুজনে আমার ছেলেদের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাবা এবং মা। কোন রকমের স্নানপর্ব মিটিয়ে দুই বাঁদরকে পাঁজাকোলা করে রওনা হলাম স্বর্গদ্বারের বাজারের দিকে। ইতি উতি ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম আমাদের ইন্দ্রপুরীতে।


স্বরগদ্বারের নিকট সমুদ্র সৈকতের উপর সাজানো দোকান পাঠ


রুটি মাংস দিয়ে নৈশভোজ সেরে দুই ছেলে নিয়ে শুরু হলো তাণ্ডব নৃত্য। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। কখনো মারামারি, কখনো দৌড়াদৌড়ি, কখনো কামড়াকামড়ি, মানে সভ্যতার বাইরে যা যা ভাবা সম্ভব সবকিছু। হাম্পিকে ধরে একটু চটকাতে যাবো- বেটা বলে উঠলো “বাবা তোমাল গালে কাতা”। বোঝো কান্ড দুই বছরের শিশু, সে কাঁটা শব্দটির প্রয়োগ শিখে গেছে। একজন খাট থেকে লাফায় তো আরেকজন সোফা থেকে, একজন জলের বোতলের ছিপি খোলে তো আরেকজন বাথরুমে ঢোকে। দাদাই-এর লাঠি নিয়ে খেলতে গিয়ে একজন নিজের চোখেই গুঁতো খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাম্মির কাছে চলে গেলো। সত্যি বলতে আধা সামরিক বাহিনী ছাড়া এদেরকে আর সামলানো সম্ভব হয়। মধ্যে মধ্যে যোগ হচ্ছে নিজেদের ভাষায় ঢেউ ও সমুদ্রের বিবরণ। এক কথায় ওদের নিয়েই এবারের পুরী জমজমাট।


পরেরদিন মোবাইলের এল্যার্মে ঘুম ভাঙল ভোর ছটায়। সূর্যোদয় মিস্ হয়ে গেছে, তবু যদি কিছু পাওয়া যায় সেই আশায় ছুটলাম সমুদ্রের দিকে। আলোকচিত্রীদের কাছে সূর্যোদয় ও সুর্যাস্ত হল সোনালি সময়। সমুদ্র, বালি, কাঁকড়া, নৌকা যা কিছু এই সময় তুলবেন সবই হবে আকর্ষণীয়। পুরীর সৈকতের এই দিকটাকে বলা হয় মডেল বিচ। স্বর্গদ্বারের তুলনায় এই জায়গাটা অনেকটাই নিরিবিলি ও জনমানবহীন। সমুদ্রের প্রান জুড়নো বাতাস তো রয়েছেই তার সাথে রয়েছে অজস্র কাঁকড়া।


অজস্র কাঁকড়া


কিছু দূরে গিয়েই চোখে পড়ল মাঝি ভাইদের নৌকা, ঠিক তাদের গ্রামের পাশেই লাগানো। পটাপট কিছু ছবি।


সকালবেলার ছবি


তারপর দ্রুততার সাথে ফিরে আসলাম, এবারে বাজার করতে যেতে হবে। স্বর্গদ্বারের পাশেই গৌড়-বাদশাহী বাজার। গড়পড়তা কলকাতার যেকোনো বাজারকেই টেক্কা দিতে পারে, সব রকমের মাছ মাংস তরিতরকারী সাজিয়ে দোকানদাররা বসে আছে গ্রাহকের অপেক্ষায়। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে পটাপট এক কেজি চিংড়ি আর দেড় কেজি পার্সে কিনে নিলাম। এরপর যা করার সুনীল করবে। আজ আবার জগন্নাথ দর্শনের দিন, দুখিশ্যাম পান্ডার সাথে আগেই কথা হয়ে আছে। ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় মন্দিরের মুখ্য ফটকের সামনে তার দাঁড়ানোর কথা। আমার এই জগন্নাথ আর বলরামকে নিয়ে সাক্ষাৎ জগন্নাথ দর্শন এই প্রথম এবং এবারে পুরী আসার সেটাই মূল উদ্দেশ্য।

চেনা ছন্দেই কাটলো সকালটা, চিংড়ির মালাইকারিটাও তোফা হয়েছিল। সুনীল কিন্তু একের পর এক ছক্কা মেরেই চলেছে। তবে এত কিছুর পরেও মনের ভেতর খুতখুতানিটা রয়েই গেল। তাহলে নতুন কিছু কি দেখব না এইবার?


চলবে...


আগের পর্বের ঠিকানা -

103 views
bottom of page