প্রথম পর্ব
এমন নয় বৈশাখের দাবদাহ অগ্রাহ্য করে আমরা আগে কখনো পুরী যাই নি, কিন্তু সামনেই বিস্তারিত ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকায় এবারে কিছুটা গররাজি ছিলাম। তার উপর আমার অধিকাংশ দু:সাহসের সঙ্গী NRS শুরুতে উৎসাহ দেখালেও পারিবারিক কারনে এবারে আর সঙ্গে নেই। NRS সঙ্গে থাকার একটা সুবিধা হল; “যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর”।কোন গন্ডগোল হলেই সব ওর ঘাড়ে দিয়ে দাও, বাবা নীলকন্ঠ বিনা বাক্যব্যয় তাহা পান করিবেন। সে রেল কোম্পানির গাফিলতি হোক বা হোটেল ওয়ালার খামতি; ভালো হলে অন্য কেউ, খারাপ NRS। শেষ যে বার ওর সাথে পুরী গিয়েছিলাম সেটা মার্চ মাসের মাঝামাঝি। দুই বন্ধু এবং দুই বৌ, স্কুটি নিয়ে চষে বেরিয়েছিলাম শহর থেকে গ্রাম, আবিষ্কার করেছিলাম কোনারকের রামচন্ডি বিচের ধারে নির্জনে নিভৃতিতে লুকিয়ে থাকা লোটাস রিসর্ট।
সেই সুখস্মৃতি আজও টাটকা। কিন্তু জগন্নাথ না টানলে কার সাধ্যি তাকে সঙ্গী করে। এই সফরে তাই নো এন.আর.এস, নো সুস্মিতা ।
পুরীর আরেক নাম পরিবার, আবার প্রতিবেশীও হতে পারে। বাঙালীর পুরী ভ্রমণের নিয়ম হল পরিবারের সকল সদস্য বা প্রতিবেশীদের যাত্রা এক প্রকার নিশ্চিত। কিছু ফেসবুক দলে আবার দেখেছিলাম নিজের প্রিয় পোষ্যকেও নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে মিনতি। যে সদস্য বা প্রিয়জনকে আমরা হারিয়েছি তারাও নিছক স্মৃতির উপর ভর করেই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আমাদের সঙ্গী হবেন- এটাই দস্তুর। আমাদের ভ্রমণসূচিতে যে তিনটি পীঠস্থান রয়েছে পুরীর স্থান সেখানে দ্বিতীয়। এই সৈকত শহরের জনপ্রিয়তা কালে কালে উর্দ্ধমুখী ও বহুল প্রচলিত, যা কিনা আমার লেখায় আবার নূতন করে ফলাও করা অবান্তর মাত্র। তাই একপ্রকার স্থির করেছিলাম চুপি চুপি জগন্নাথ দর্শন করে ঘুরে আসবো। এখানে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। আর আমার দরকারই বা কি খামখা চাপ নেওয়ার। কিন্তু আমার একটা ছোট্ট ভুল বা অসাবধানতা আমার কাল হল।
আসলে দক্ষিণ ভারতে মন্দির ও সমুদ্র সৈকতের এতই প্রাচুর্য্য যে সে সব ছেড়ে দক্ষিণভারতীয়দের পুরী আসবার দরকার পরে না। তাদের কাছে পুরী নামটা পৌছে দিতেই বিজয়ওয়ারা স্টেশনে বসে ফেসবুকে একটা আপডেট দিলাম।
“Travelling to Puri from Vijayawada, Nothing Official about it.” ব্যস কেলেংকারিটা হয়েই গেলো। পটাপট কমেন্ট…
অয়ন বললো “এমন কিছু ছবি তুলো যা সবাই দেখে কেউ তোলে না”-বোঝ ঠেলা, সবাই যদি দেখেও ছবি না তোলে আমিই বা তুলব কেন। বিশ্বরূপের আবদার সে নাকি আমার চোখে পুরীটা নতুন করে দেখতে চায়। আর আদিত্যর আবদার সে আরেকটা নতুন গল্পের অপেক্ষায়।
একে তো এই ধ্বজা মার্কা তিরুপতি-পুরী এক্সপ্রেস। এবিপি আনন্দ যেমন বিজ্ঞাপনের মধ্যে মধ্যে খবর দেখায়- এই রেলগাড়িটিও থামার ফাঁকে ফাঁকে চলে। গোদের উপর বিষ ফোড়া- এমন কোনো জায়গায় ইনি দাঁড়াননা যেখানে খাবার পাওয়া যাবে। ভোরবেলা অবধি বিশাখাপট্টনামের ভরসায় বসে থাকলে রাত্রে কি খাব? একবার নামলাম ভিমাভরাম স্টেশনে, হায় কপাল ! আশা করেছিলাম অন্তত ইডলি, বড়া পাবো; কিন্তু লেবু-চা আর জল ছাড়া কিছুই নেই। ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে ফিরে এলাম নিজের জায়গায়। ততক্ষণে আমার নাকচ করা আণ্ডা বিরিয়ানির শেষ নমুনাটি সাইড আপার বার্থের চিমসে ছেলেটি উদরস্থ করছে। অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই কেমন একটা গা পিত্তি জ্বালানো হাসি দিল। কি আর করবো নিজের নির্বুদ্ধিতায় স্টেশন থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেটও কিনি নি যে তাই দিয়ে রাতের খাবার সারি। ধরে নিলাম সাক্ষাত জগন্নাথদেব দর্শন দেবার আগে আমার উপোসের ব্যবস্থা করেছেন ।
পরিকল্পনা করেই উপরের বার্থে জায়গা নিয়েছি। ট্রেনে উঠেই লক্ষ্য করেছি আমার খুদে সহযাত্রীটি মোটেও সুবিধার নয়। আমার পুত্রদের ন্যায় চঞ্চল ও বায়নাবাজ। রাত যত এগুচ্ছে তার সুর ততো চড়ছে। বাড়ির লোকজন দুই পাশের দুই আপার বার্থের রেলিঙ থেকে রেল কোম্পানির চাদর দিয়ে তার জন্য দোলনা বানিয়েছে। সেটার ভিতরেই তাকে ময়দার মতো বেলছে। আর তারই তালে তালে চলছে ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার। অগত্যা পেটে ক্ষিদে আর কানে চিৎকার নিয়ে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে শবদেহের মত শুয়ে পড়লাম।জয় জগ্গনাথ!
খুব ভোরে ঘুম ভাঙল ক্ষিদের চোটে। খুদে যাত্রী তার পরিবার নিয়ে হাওয়া। নেমে গেছে না নামিয়ে দিয়েছে জানিনা। ট্রেনের দুলুনিটাও নেই। ট্রেন জার্নির সকালটা জিমে একটু বেশি সময় কাটাই, তাতে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই ঘুমটা জম্পেস হয়। গতকালও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
যাই হোক এলাম কোথায়?
বাহ এই তো ভাইজ্যাগ।
টুপ্ করে উপর থেকে ঝরে পড়লাম। কামরার বাইরেই চা বিস্কুট কেক সবই পাওয়া যাচ্ছে, শুধু হাত বাড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। বেস কিছু বিস্কুট আর কেক মুখের ভিতর চালান দিয়ে তবে তৃপ্তি। তারপর কফির কাপে চুমুক দিতেই চোখ গিয়ে আটকাল স্টেশনের ডিজিট্যাল ঘড়ির দিকে। দেখেছ কান্ড? যে ভাইজাগ আকছার পাঁচ ছয় ঘণ্টাতে পৌছাই সেটাই এবার প্রায় এগারো ঘন্টা ধরে এসেছি। আর হবে নাই বা কেন? অটোর মত প্রতি স্টপেজে যদি বাড়ি থেকে ডেকে ডেকে লোক আনে সময় তো লাগবেই। তবে সময় সারণীর বিচারে গাড়ী কিন্তু ঠিক সময়েই চলেছে। আসলে তার চরিত্রটি এইরকমই। যাইহোক এই গতিতে দুপুর তিনটের দিকে পুরী পৌছব। সরাসরি ট্রেন, তাই মাঝে পাল্টাপাল্টির ঝামেলা নেই -এটাই যা বাঁচোয়া। আপাতত ট্যাঙ্কি ফুল করে শরীরটাকে আবার চালান করে দিলাম নিজের বার্থে।
চিন্তাটা মাথায় ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। হাতের তালুর মত চেনা পুরীতে ভ্রমনরসিকদের কি সত্যি নতুন করে কিছু পাওয়ার আছে? একেবারে নতুন না হোক, যদি পুরনো জিনিসের কোন নতুন রূপ দেখা যায় তাই বা কম কই? দেখাই যাক ভাগ্যে কি আছে।
চলবে...
পরবর্তি পর্বের ঠিকানা
Comments