top of page

গোকর্ণ : আ ওয়াক টু রিমেম্বার

Updated: Apr 6, 2019

অয়ন ভট্টাচার্য্য



প্রথম ভাগ :

সাড়ে সাতটা কিন্ত বেজে গেছে অনেকক্ষন, এরপর দেরি করলে সিওর বাসটা মিস হয়ে যাবে, এই কথা বলে আমি চট করে একবার হাতঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললাম। ক্যাব বুক হয়ে গেছে অনেকক্ষণ , পাশের ঘর থেকে তারস্বরে জানালো নন্দিনী । তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ক্যাব ড্রাইভার আন্না ফোন করে জানালেন তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত । প্রায় পৌনে আটটা নাগাদ আমরা সপ্তাহান্তের মত পাততাড়ি গুটিয়ে রওনা হলাম । আপাতত গন্তব্য স্থল ব্যাঙ্গালোর এম জি রোড, সেখান থেকে রাত 9 টায় আমাদের বাস ছাড়বে । আমরা আসলে চলেছি গোকর্ণ , বিচ ট্রেক করতে । আমরা মানে নন্দিনী আর আমি । নন্দিনী হচ্ছে আমার মাধ্যমিকের সময়কার বন্ধু । মাধ্যমিক পরীক্ষা ইস্তক আমাদের সব কিছু একসাথে। দীর্ঘ এক দশক হাসি ঠাট্টা কান্না মান অভিমান খুনসুটি মারামারি সবকিছু একসাথে পেরিয়ে আমরা আজকে কয়েক বছর হল কলকাতা ছাড়া । আমি একটি সরকারি ব্যাংকে কর্মরত , আপাতত বাসস্থান চেন্নাই। নন্দিনী একটি মাল্টিন্যাশনাল আইটি ফার্মের কনসালটেন্ট । সে আস্তানা গেড়েছে ব্যাঙ্গালোরে। নন্দিনীর আরেকটা পরিচয় হলো সে আমার সহধর্মিনী । যাই হোক মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক , আজ সকালেই অমৃতা মেইল করে জানিয়েছে আমরা সব শুদ্ধ চোদ্দ জন চলেছি এই বিচ ট্রেকিং এ । আমরা যাচ্ছি নেচার ওয়াকার্স নামক একটি সংস্থার সাথে যারা ব্যাঙ্গালোর এবং চেন্নাই থেকে উইকেন্ড ট্রেক এর আয়োজন করে থাকে । অমৃতা এই সংস্থার সাথেই যুক্ত । আমাদের দলের বাকি সদস্যরা বাস ধরবে ডোমলুড় এবং কোরমঙ্গলা থেকে । বাস তাদের নিয়ে সবশেষে এম জি রোড আসবে আমাদের নিতে । আমরা যখন এম জি রোড এসে পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন পৌনে নটা নেচার ওয়াকারের দেওয়া ট্যুর কোঅর্ডিনেটর এর নম্বরে ফোন করে জানতে পারলাম বাস কোরমঙ্গলা ছেড়েছে খানিক আগে , এম জি রোড এসে পৌঁছতে আরো মিনিট পনেরো লাগবে । সুতরাং এই মিনিট পনেরো সময়ে গোকর্ণর ঘাতঘোত টা একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক । গোকর্ণ আরবিয়ান সমুদ্রসৈকতে ধারে অবস্থিত কর্ণাটকের একটি শহর । শহরটি মূলত মহাবালেশ্বর মন্দির এর জন্য বিখ্যাত । তবে হালফিলে জায়গাটিকে ভারতবর্ষের হিপি ডেস্টিনেশন আখ্যা দেওয়া হয়েছে । গোকর্ণ তার সমুদ্র সৈকতের জন্য বিখ্যাত । গোকর্ণ থেকে সি লাইন ধরে 100 কিলোমিটার এগিয়ে গেলে গোয়া পৌঁছানো যায় । তারই মধ্যে ঝনঝন করে পকেটের ফোনটা বেজে উঠলো । ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপ্রান্ত থেকে একজন মিহি গলায় জানালো যে বাস পৌঁছে গেছে এমজি রোডে। আমরা তড়িঘড়ি সিগন্যাল পেরোতেই রাস্তার অপর প্রান্তে ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাভেলার বাস থেকে দেখতে পেলাম । অমোঘ, আমাদের টুর কো-অর্ডিনেটর রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে ছিল । তার সাথে আলাপ পরিচয় সেরে তার পেছনে পেছনে আমরা বাসে গিয়ে উঠলাম । মাথার ওপরে ব্যাগ পত্র ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে রেখে সিট দখল করতে না করতেই বাস ছেড়ে দিল। অমোঘের সাথে কথা বলে জানলাম আমাদের এই দলের আরেক সদস্য সুশীল চৌরাসিয়া যশবন্তপুর থেকে বাস ধরবে, তাই সেখানেই যাওয়া হবে এবার। গুছিয়ে বসে পাশের জানলাটা ফাক করলাম অল্প করে। একতাল দমকা হাওয়া নন্দিনীর চুল এলোমেলো করে দিলো । বেশ মন ভালো করা মিষ্টি সোদা গন্ধ লাগলো নাকে । হু হু করে বাতাস বইছে, মিশকালো অন্ধকারের মধ্যে জানলার বাইরে হাতটা সামান্য ছুঁড়ে দিতেই হাওয়া কেটে গেলো খানিকটা , সাথে বুঝলাম বৃষ্টিও শুরু হয়েছে ঝিরি ঝিরি ।


দ্বিতীয় ভাগ :

বাস যশোবন্তপুর ছেড়েছে অনেকক্ষণ। আমরা এখন ব্যাঙ্গালোর শহরের প্রায় শেষ সীমানায় । বাসের যাত্রীরা সবাই যে যার সিটে গা এলিয়ে , কেউ বসে, কেউ বা ঝুঁকে, কেউবা মাথার টুপি মুখের উপর টেনে শুয়ে থাকার ভান করে রয়েছে , আমাদের বাসটা শহরের শেষ টোলপ্লাজা টা ক্রস করতেই আমাদের দলের আরেক ট্যুর কো-অর্ডিনেটর হর্ষিতা বলে উঠলো , কামন গাইজ লেটস ব্রেক দা আইস । চলো আমরা সবাই একে একে নিজের জায়গা ছেড়ে ড্রাইভারের সিটের পেছনে এসে দাঁড়াই আর নিজেকে মেলে ধরি বাকি সবার সামনে । এইভাবে আলাপচারিতার ম্যাধমে একে একে আমাদের দলের সকলের সাথে পরিচয় পর্ব টা সেরে ফেলা গেলো। আমাদের টিমের তিনজন কো-অর্ডিনেটর । প্রথমজন এবং সিনিয়র মোস্ট অমোঘ । অমোঘ ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা এবং মাস কমিউনিকেশন এর ছাত্র । অমোঘ নেচার ওয়াকার্স এর সাথে যুক্ত বছর খানেক ধরে এবং এই অল্প সময়ে এর মধ্যেই অমোঘ কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুর বেশকিছু ট্রেক কোঅর্ডিনেট করে ফেলেছে । আমাদের গ্রুপের দ্বিতীয় এবং সর্বকনিষ্ঠ কো-অর্ডিনেটর বিপুল শর্মা । বিপুল আসামের ছেলে এবং সর্বক্ষণ মিউজিক আর মাউন্টেনিয়ারিং এ মজে থাকে । বিপুল এদের মধ্যে সবচেয়ে কম কথা বলে। তার সাথে সামান্য বাক্যালাপে জানলাম সে আজ মাস কয়েক হলো ব্যাঙ্গালোরে এসেছে বিকম নিয়ে পড়তে তার সাথে কথা বলে আরও জানতে পারলাম তার হোস্টেল কলেজ থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে এবং সে রোজ হোস্টেল থেকে এক রকম ঘড়ি ধরে স্প্রিন্ট করে কলেজে যায় । বিপুল প্রথম ট্রেকে অংশগ্রহণ করে যখন ও ক্লাস ফাইভ এর ছাত্র । পশ্চিম বাংলার সান্দাকফু ট্রেক এবং বিপুলের কথায় তার জীবনের অন্যতম সেরা ট্রেকিং এক্সপেরিয়েন্স। কো-অর্ডিনেটর টিমের তৃতীয় ও একমাত্র মহিলা সদস্য হার্শিতা। হার্শিতা ম্যাঙ্গালোরের মেয়ে । পড়াশোনা সূত্রে নিজের বাবা মা পরিবার ছেড়ে বেশ কয়েক বছর ব্যাঙ্গালোরে হোস্টেলে বসবাস করছে । হার্শিতা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার গোকর্ন বিচ ট্রেকে পার্টিসিপেট করছে । যদিও এইবার তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও একপ্রকার জোর করেই তাকে কোঅর্ডিনেটর হিসেবে আমাদের সাথে পাঠানো হয়েছে । আমাদের বাস তখন ন্যাশনাল হাইবে ফর্টি এইট হয়ে তীর বেগে ছুটে চলেছে আর বাসের ভিতর পুরোদমে চলছে ইন্ত্রডাক্টরি সেশন । বাকিদের মধ্যে সর্বপ্রথম নিজেদের ইন্ট্রোডাকশন দিল লিনফোর্ড আর এন্যেট এনা জেমস। লিনফোর্ড আর এনার মাস কয়েক হলো বাগদান পর্ব মিটেছে । আগামী মে মাসে বিয়ে দুজনের, সুতরাং বিয়ের আগে এটা তাদের শেষ ব্যাচেলর ট্রিপ । দুজনেই ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং কেরালা ত্রিশূর এর বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে আছে করে বেশ কয়েক মাস । দুজনেই আইটি প্রফেশনাল। লিনফোর্ডের নেশা ফুটবল এবং সে তার স্কুল ও কলেজ জীবনে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছে শুধু তাই ই নয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তার কলেজের হয়ে রিপ্রেজেন্ট করেছে । ওপর দিকে এনার খেলাধুলা তে বিশেষ আগ্রহ নেই । সে চায় ফ্যাশন ফটোগ্রাফার হতে এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন ফটোগ্রাফি ক্লাবের সাথেও যুক্ত । তারপর আলাপ হলো সুর আর জেনির সাথে । সুরের পুরো নাম আমি আজ অব্দি উচ্চারণ করে উঠতে পারিনি । জেনি ওরফে জেনি জেরেমায়া সুরের স্ত্রী এবং অন্যতম ট্রাভেল পার্টনার ।সুর ইউ পির ছেলে হলেও বাবার এয়ারফোর্স এর চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেছে । সুর একটি ফরাসি ব্যাংকের আই টি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডিপার্টমেন্ট এর হেড । জেনি মালায়লি হলেও বাড়ি কন্যা কুমারী তে। জেনি একটি বেসরকারি সংস্থার হিউম্যান রিসোর্সের দ্বায়িত্ব সামলায়। দুজনেই ট্রেকিং ভালোবাসে এবং দু বছর আগে কোন একটি ট্রেকে আলাপ এই দুই ট্রেক যুগলএর । গত বছর অক্টোবর মাসেএনারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন । এবার আসি স্নেহা আর অনুরাগ এর কথায়। দুজনেই দিল্লির বাসিন্দা এবং কর্মসুত্রে ব্যাঙ্গালোরে বসবাস করে । হাসিঠাট্টার মাঝে জানতে পারলাম অনুরাগ তার ভুলো মনের জন্য বন্ধুদের কাছে বারংবার অপদস্ত হয় এবং স্নেহার ঘন ঘন অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে । স্নেহার মুখে শুনলাম অনুরাগ নাকি তাদের প্রথম ডেটে নিজের ওয়ালেট ভুলবশত বাড়িতে ফেলে আসে আর রেস্টুরেন্টের বিল মেটানোর সময় সেটা তার বোধগম্য হয় । ডেট পর্ব মিটতে স্নেহা অনুরাগ এর জন্য নিজের ফোন থেকে ক্যাব বুক করে ওকে বাড়ি পাঠায় অথচ তার যে বাড়ি ফিরে স্নেহাকে খবর দেওয়া উচিত সে কথাটা অনুরাগ জি বেমালুম ভুলে মেরে দেয় । পরে জিজ্ঞেস করা হলে অনুরাগের অকাট্য যুক্তি ক্যাব তো নেহার ফোনে বুক করা , আমি বাড়ি পৌঁছেছি কিনা তার আপডেট তো ও নিজের ফোন থেকেও পেতে পারে । বাসে একটা ছোট খাটো হাসির কলরব ওঠে । হাসির রেশ এবং উদ্যম কমতে আমাদের গ্রুপের আরেক সদস্য শাহরুখ খান নিজের পরিচয় দেন । না এনি কিং খান নন তবে ইনিও দিল্লির বাসিন্দা এবং সেলস এর চাকরির সুবাদে ব্যাঙ্গালোর কে ভালোবেসে ফেলেছেন । ঘটনাচক্রে সেইদিন খান সাহেবের জন্মদিন ও বটে এবং সে কথা বাসের বাকি লোকেরা জানতে পারার পর বার্থডে বাম্প এর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে ওনার শেষটায় উরি বাবা অবস্থা হয়েছিল । পরে ওর কাছে শুনেছিলাম যে এই ঘটনার পর আগামী দুদিন ও বিছানায় চিৎ হয়ে শোয়ার শক্তি, সামর্থ্য সব হারিয়েছিল । আমাদের দলের আরেক সদস্য ছিল জে ডি , পুরো নাম মনে নেই এই মুহূর্তে । জে ডি ওয়েস্ট বেঙ্গল এ জন্মালেও বড় হয়েছে ত্রিপুরায় এবং এখন কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরের রেসিডেন্ট । জে ডি পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার । মারাঠি মুলগী রস্মির বাড়ি মুম্বাইতে । আমাদের দলের অনলি সোলো ফিমেল ট্রাভেলার । রশ্মি চাকরি করে ফ্লিপকার্টে, সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে । রস্মির গত দু'মাসের মধ্যে এটা দ্বিতীয় গোকর্ণ ট্রিপ । রস্মি বেশ মিশুকে, খানিক টা গায়ে পড়া , কনফিডেন্ট এন্ড আউটগোয়িং এবং প্রাণোচ্ছল । আমাদের দলে আয়ুস এবং আকাঙ্ক্ষা ও ছিল যদিও তাদের সাথে আমার আলাপ জমে নি সেরকম। আয়ুস ছিল কোরিওগ্রাফার এবং এবং টাটকা প্রেমিক হওয়ায় তাকে সর্বক্ষণ আকাঙ্খার সাথে আলিঙ্গনবব্ধ অবস্থাতেই দেখতে পেতাম । কে জানে চোখের বা মনের ভুল ও হতে পারে, অথবা দুটোই । যাক গে সে সব কথা , কাজের কথায় মননিবেষ করি বরং । আমাদের দলের শেষ সদস্য মধ্যপ্রদেশের সুশীল চৌরাসিয়া । সুশীল গ্রামের ছেলে, বাকিদের মত গড় গড় করে ইংলিশ বলতে পারে না । হিন্দি বলে , দেহাতি উচ্চারণে , কথা বার্তায় মাটির টান স্পষ্ট । প্রথম দর্শনে গাইয়া মনে হলেও ছেলেটির সরলতা এবং কথার ধার, ভার, বাঁধুনি দেখে ভালোলাগতে বাধ্য । সুশীল ব্যাঙ্গালোর আইএসআই এর ছাত্র , ভবিষ্যতে গণিতের প্রফেসর হওয়ার ইচ্ছে এবং গত তিন মাস ধরে ও লাগাতার উইকেন্ড ট্রেকিং এ অংশগ্রহণ করে চলেছে । সুশীল এর আরেকটি শখ হল ভিডিও ব্লগিং । তার সমস্ত ঘুরে বেড়ানোর জায়গার ভিডিও রেকর্ডিং করে সে ব্লগ বানায় । এই আলাপচারিতা ক্রমশ জমে ওঠায় কখন যে রাতের খাবারের সময় হয়েছে কারুরই খেয়াল ছিল না । রাত পৌনে বারোটা নাগাদ আমাদের বাস টুমকুর ছাড়িয়ে একটি রোডসাইড ধাবায় খানিকক্ষণের জন্য থামল । রাত সাড়ে বারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে আমরা আবার বাসে চড়ে বসে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে । ইতিমধ্যে হার্ষিতা জানাল আমাদের গোকর্ণ পৌঁছতে আগামীকাল ভোর সাতটা বেজে যাবে । আমি এইসব ঘোরা ঘুরির ব্যাপারে বরাবরই একটু ইমপেসেন্ট । হর্ষিতার কথা শোনা ইস্তক ভোর হওয়ার জন্য উসখুস করছিলাম । দেখতে দেখতে রাত একটার মধ্যে চারিদিক নিঝুম হয়ে গিয়ে যে যার মত ঘুমে তলিয়ে গেল। কেউ বসে , কেউ পুশ ব্যাক সিটে হেলান দিয়ে , কেউবা দুটো সিটের মাঝে পা ছড়িয়ে , কেউ বাসের দেওয়ালে পা তুলে দিয়ে ,কেউ আবার প্রবল নাসিকা গর্জনে তার উপস্থিতি জানান দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল । আমার পাশে বসা নন্দিনী ও ঘাড় কাত করে সামান্য মুখ হা করে ঘুমিয়ে কাদা । সবাই যখন ঘুমের দেশে , তখনও গোটা বাসে দুটো প্রাণী জেগে । ড্রাইভার ভাইসাব নিবিষ্ট মনে হাওয়ার গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে চলেছে আর আমি অস্থির মনে গোকর্ণ পৌঁছানোর অপেক্ষা করে চলেছি । যেন পাল্লা দিয়ে রাত জাগার অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে দুজনের । আর জেগে আছে বৃষ্টির মেঘের ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়ানো উজ্জ্বল তামাটে আভায় উপচে পড়া একফালি চাঁদ টা । হালকা বৃষ্টির পরে আকাশে জায়গায় জায়গায় পেঁজা তুলোর মত গোছা গোছা মেঘ ফুটে আছে । গোকর্ণ পৌঁছনো এবং আগামীকালের ট্রেকিং অ্যাক্টিভিটি নিয়ে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমার চোখের পাতা দুটো জড়িয়ে এলো । পাশ দিয়ে একটা মফস্বল এর বাস প্যা প্যা প্যা প্যা সুর তুলে দারুণ গতিতে অন্ধকার চিরে ছুটে বেরিয়ে গেল । ঘুমচোখ খুলে বিরক্ত চোখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চাইলাম । আকাশের দিকে তাকিয়ে আধবোজা চোখে চাঁদটাকে মেপে আবার চোখ বুজলাম ।

তৃতীয় ভাগ :

নাহ, আজকের রাতটা বালির ওপরেই শুয়ে বসে কাটাতে হবে মনে হচ্ছে, অমলেটের টুকরোটা পাউরুটির ভেতর গুঁজতে গুঁজতে বলল জেনি । আমরা গতবার যখন গোকর্ণ এসেছিলাম নেচার ওয়াকার্স এর সাথে , সেবার ওরা সবাই কে ইন্ডিভিজুয়াল কটেজে থাকতে দিয়েছিল, সুর বাবু বৌ এর কথার সুর টেনে বলল । আর যাই হোক টেন্টে রাত কাটানো আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব ,কাঁধ ঝাকিয়ে তালে তাল মেলালো এনা । আমরা গোকর্ণ এসে পৌঁছেছি ঘন্টা খানেক হলো । রাতে ঘুম তেমন হয়নি আমার এবং নন্দিনী ও একই কথা বলল নিজের ঘুম সম্পর্কে । যদিও আমি ঘড়ি ধরে গুনেছি ও পাক্কা ছটি ঘন্টা ঘুমিয়েছে কাল রাত থেকে । সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস আমাদেরকে গোকর্ণ টাউনের বাস ডিপোতে নামিয়ে দেয় । সেখান থেকে নেচার ওয়াকার্সের বন্দোবস্ত করা আরেকটি ট্রাভেলার এ চড়ে আমরা গোকর্ণ মেন বিচের সংলগ্ন এলাকায় এসে পৌঁছলাম । বাস রাস্তা যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকে গোকর্ণ বিচ প্রায় দেড় কিলোমিটারের পথ । কাঁচা মেঠো রাস্তা , তার দুপাশে ঝোপঝাড় , আগাছা, কাটা গাছ আর কিছু একচালা কুঁড়েঘর । সেই লাল মাটির এবড়ো খেবরো উঁচু নিচু রাস্তা ধরে সোজা হেটে যেতেই খানিক পরে সমুদ্রের গন্ধ নাকে এলো । আরো কিছুদূর চলার পর , সোজা ঢালু রাস্তা যেখানে নেমে গেছে সেখানে হালকা নীলচে সমুদ্রের রেখা দেখতে পেলাম । রাস্তাটা এসে মিশেছে সমুদ্র সৈকতের বালিতে । বালির উপর দিয়ে কিছুটা হাঁটলেই আরব সাগর । গরমে খানিকটা কাহিল আর নিস্তেজ । ছোট ছোট ঢেউ গুলো কেমন মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই বালিতে লুটিয়ে পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে । আবার খানিক পর আরেকটা কমজোরি ঢেউ এসে সেগুলো কে কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । এই সব দেখতে দেখতে আমরা বালির উপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে মুখ করে হেঁটে চললাম । আগে আগে চলেছে আমাদের তিন বিশ্বস্ত সেনাপতি , অমোঘ, বিপুল এবং হার্শিতা। কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের হোমস্টের দেখা মিলল । হোম স্টে তে আমাদের জন্য দুটো ঘরে বন্দোবস্ত করা ছিল । একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে দের । হোমস্ স্টে তে ঢোকা মাত্রই যে যার নিজেদের ঘর গুলিতে পৌঁছে ব্যাগ পত্র ছেড়ে কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে দুদ্দাড় করে বাথরুমের দিকে ছুটলাম । ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় আমি প্রথম চেষ্টাতেই বাথরুম ব্যবহার করার সুযোগ পেলাম । ঘর গুলি থেকে খানিক দূরে সারি দেওয়া পর পর ছটি বাথরুম । হার্শিতা ভোরবেলাতেই জানিয়ে দিয়েছিল আজকে আমাদের সকলের বালতি মগ নিয়ে স্নানের ছুটি । গোসল পর্ব সমুদ্রতেই সারা হবে । সুতরাং আমরা যে যার মত হাত মুখ ধুয়ে প্রকৃতির ডাকের সাড়া মিটিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বিচ লাগোয়া শ্যাক এ এসে হাজির হলাম । বুফে ব্রেকফাস্ট । আয়োজন খুব বেশি নয় । ইডলি , বড়া, সম্বর, চাটনি , পাউরুটি অমলেট আর সামান্য কাট ফ্রুটস দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা হল । আয়োজন এলাহি না হলেও সবটাই বাড়ির রান্না এবং সুস্বাদু । ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে হঠাৎ চোখ গেল বিচের ওপর পেতে রাখা সারি সারি টেন্ট গুলোর দিকে । আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী আজ রাতে ওই গুলোই আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই । টেন্ট দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠলো । কয়েকজনের মুখের অবস্থা তো দেখার মত । আমাদের দলের জেনি রাত কাটানোর এই সুবন্দোবস্থ দেখে কেমন একটা ভেবলে গিয়ে বিষম খেয়ে অস্থির । তবে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম । খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো আমার বহুদিনের শখ এবং তার সাথে উপরি পাওনা আকাশ ভরা ফুলের কুঁড়ির মত ফুটে থাকা তারাদের মেলা, মিঠে মনমাতানো সি ব্রিজ আর সমুদ্রের তর্জন গর্জন । এইসবের আধঘণ্টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে আমরা যে যার মত তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলাম । আমাদের সকলেরই পরনে টি শার্ট এবং শর্ট বা ট্রেকিং ট্রাউজার্স । কাঁধের জলের বোতল এবং অন্যান্য ট্রেকিং সরঞ্জামসহ ছোট ব্যাগ । অনেকের মাথায় টুপি বা ব্যান্ডানা । চোখে রোদচশমা । সকলেই মোটামুটি যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে রেডি । সেনাপতিরা শিঙে ফুকলেই সবাই রে রে করে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়বে । আমাদের ট্রেকিংয়ের রুট ম্যাপ টা একবার জানিয়ে রাখা যাক । আমরা গোকর্ণ বিচ থেকে সামনের দিকে হেঁটে গডস ওন বিচে পৌঁছাব । সেখান থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হলে আমাদের রাস্তায় একে একে পড়বে প্যারাডাইস বিচ, হাফ মুন বিচ , ওম বীচ , কুডলে বিচ এবং সেখান থেকে আরও সামনে হেটে আমরা আবার আমাদের হোমস্টে তে ফিরে আসব । গোকর্ণ বিচ যেমনটা ভাবছো আদপে তেমন টাএকেবারেই নয় । গোকর্ণ তে এক বিচ থেকে অপর বিচে পৌঁছতে রীতিমত পাহাড় ডিঙাতে হয় । তুলনায় বালির উপরে হাঁটাহাঁটি কম । ঘড়িতে তখন সাড়ে নটা , আমরা একে একে লাইন করে আমাদের হোমস্টের গেটের সামনে এসে জড়ো হলাম । অমোঘ সবাইকে এক ফ্রেমে রেখে তার ফোনের ক্যামেরায় একটি ছবি তুলল । আমাকে তখন সমুদ্রে পেয়েছে, আমি হাঁ করে নিবিড় মনে সমুদ্রের ঢেউয়ের উথাল-পাথাল গিলছি । কতক্ষণ পরে খেয়াল নেই অমোঘ এর গলা পেলাম, কাম অন হারি আপ । পাশ ফিরে দেখি বাকিরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে ,মায় নন্দিনীও,আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হ্যাচর প্যাঁচর করতে করতে বালির উপর দিয়ে ছুটলাম ।


তৃতীয় ভাগ :

নাহ, আজকের রাতটা বালির ওপরেই শুয়ে বসে কাটাতে হবে মনে হচ্ছে, অমলেটের টুকরোটা পাউরুটির ভেতর গুঁজতে গুঁজতে বলল জেনি । আমরা গতবার যখন গোকর্ণ এসেছিলাম নেচার ওয়াকার্স এর সাথে , সেবার ওরা সবাই কে ইন্ডিভিজুয়াল কটেজে থাকতে দিয়েছিল, সুর বাবু বৌ এর কথার সুর টেনে বলল । আর যাই হোক টেন্টে রাত কাটানো আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব ,কাঁধ ঝাকিয়ে তালে তাল মেলালো এনা । আমরা গোকর্ণ এসে পৌঁছেছি ঘন্টা খানেক হলো । রাতে ঘুম তেমন হয়নি আমার এবং নন্দিনী ও একই কথা বলল নিজের ঘুম সম্পর্কে । যদিও আমি ঘড়ি ধরে গুনেছি ও পাক্কা ছটি ঘন্টা ঘুমিয়েছে কাল রাত থেকে । সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস আমাদেরকে গোকর্ণ টাউনের বাস ডিপোতে নামিয়ে দেয় । সেখান থেকে নেচার ওয়াকার্সের বন্দোবস্ত করা আরেকটি ট্রাভেলার এ চড়ে আমরা গোকর্ণ মেন বিচের সংলগ্ন এলাকায় এসে পৌঁছলাম । বাস রাস্তা যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকে গোকর্ণ বিচ প্রায় দেড় কিলোমিটারের পথ । কাঁচা মেঠো রাস্তা , তার দুপাশে ঝোপঝাড় , আগাছা, কাটা গাছ আর কিছু একচালা কুঁড়েঘর । সেই লাল মাটির এবড়ো খেবরো উঁচু নিচু রাস্তা ধরে সোজা হেটে যেতেই খানিক পরে সমুদ্রের গন্ধ নাকে এলো । আরো কিছুদূর চলার পর , সোজা ঢালু রাস্তা যেখানে নেমে গেছে সেখানে হালকা নীলচে সমুদ্রের রেখা দেখতে পেলাম । রাস্তাটা এসে মিশেছে সমুদ্র সৈকতের বালিতে । বালির উপর দিয়ে কিছুটা হাঁটলেই আরব সাগর । গরমে খানিকটা কাহিল আর নিস্তেজ । ছোট ছোট ঢেউ গুলো কেমন মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই বালিতে লুটিয়ে পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে । আবার খানিক পর আরেকটা কমজোরি ঢেউ এসে সেগুলো কে কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । এই সব দেখতে দেখতে আমরা বালির উপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে মুখ করে হেঁটে চললাম । আগে আগে চলেছে আমাদের তিন বিশ্বস্ত সেনাপতি , অমোঘ, বিপুল এবং হার্শিতা। কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের হোমস্টের দেখা মিলল । হোম স্টে তে আমাদের জন্য দুটো ঘরে বন্দোবস্ত করা ছিল । একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে দের । হোমস্ স্টে তে ঢোকা মাত্রই যে যার নিজেদের ঘর গুলিতে পৌঁছে ব্যাগ পত্র ছেড়ে কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে দুদ্দাড় করে বাথরুমের দিকে ছুটলাম । ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় আমি প্রথম চেষ্টাতেই বাথরুম ব্যবহার করার সুযোগ পেলাম । ঘর গুলি থেকে খানিক দূরে সারি দেওয়া পর পর ছটি বাথরুম । হার্শিতা ভোরবেলাতেই জানিয়ে দিয়েছিল আজকে আমাদের সকলের বালতি মগ নিয়ে স্নানের ছুটি । গোসল পর্ব সমুদ্রতেই সারা হবে । সুতরাং আমরা যে যার মত হাত মুখ ধুয়ে প্রকৃতির ডাকের সাড়া মিটিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বিচ লাগোয়া শ্যাক এ এসে হাজির হলাম । বুফে ব্রেকফাস্ট । আয়োজন খুব বেশি নয় । ইডলি , বড়া, সম্বর, চাটনি , পাউরুটি অমলেট আর সামান্য কাট ফ্রুটস দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা হল । আয়োজন এলাহি না হলেও সবটাই বাড়ির রান্না এবং সুস্বাদু । ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে হঠাৎ চোখ গেল বিচের ওপর পেতে রাখা সারি সারি টেন্ট গুলোর দিকে ।


চোখ গেল বিচের ওপর পেতে রাখা সারি সারি টেন্ট গুলোর দিকে


আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী আজ রাতে ওই গুলোই আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই । টেন্ট দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠলো । কয়েকজনের মুখের অবস্থা তো দেখার মত । আমাদের দলের জেনি রাত কাটানোর এই সুবন্দোবস্থ দেখে কেমন একটা ভেবলে গিয়ে বিষম খেয়ে অস্থির । তবে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম । খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো আমার বহুদিনের শখ এবং তার সাথে উপরি পাওনা আকাশ ভরা ফুলের কুঁড়ির মত ফুটে থাকা তারাদের মেলা, মিঠে মনমাতানো সি ব্রিজ আর সমুদ্রের তর্জন গর্জন । এইসবের আধঘণ্টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে আমরা যে যার মত তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলাম । আমাদের সকলেরই পরনে টি শার্ট এবং শর্ট বা ট্রেকিং ট্রাউজার্স । কাঁধের জলের বোতল এবং অন্যান্য ট্রেকিং সরঞ্জামসহ ছোট ব্যাগ । অনেকের মাথায় টুপি বা ব্যান্ডানা । চোখে রোদচশমা । সকলেই মোটামুটি যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে রেডি । সেনাপতিরা শিঙে ফুকলেই সবাই রে রে করে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়বে । আমাদের ট্রেকিংয়ের রুট ম্যাপ টা একবার জানিয়ে রাখা যাক । আমরা গোকর্ণ বিচ থেকে সামনের দিকে হেঁটে গডস ওন বিচে পৌঁছাব । সেখান থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হলে আমাদের রাস্তায় একে একে পড়বে প্যারাডাইস বিচ, হাফ মুন বিচ , ওম বীচ , কুডলে বিচ এবং সেখান থেকে আরও সামনে হেটে আমরা আবার আমাদের হোমস্টে তে ফিরে আসব । গোকর্ণ বিচ যেমনটা ভাবছো আদপে তেমন টাএকেবারেই নয় । গোকর্ণ তে এক বিচ থেকে অপর বিচে পৌঁছতে রীতিমত পাহাড় ডিঙাতে হয় । তুলনায় বালির উপরে হাঁটাহাঁটি কম । ঘড়িতে তখন সাড়ে নটা , আমরা একে একে লাইন করে আমাদের হোমস্টের গেটের সামনে এসে জড়ো হলাম । অমোঘ সবাইকে এক ফ্রেমে রেখে তার ফোনের ক্যামেরায় একটি ছবি তুলল । আমাকে তখন সমুদ্রে পেয়েছে, আমি হাঁ করে নিবিড় মনে সমুদ্রের ঢেউয়ের উথাল-পাথাল গিলছি । কতক্ষণ পরে খেয়াল নেই অমোঘ এর গলা পেলাম, কাম অন হারি আপ । পাশ ফিরে দেখি বাকিরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে ,মায় নন্দিনীও,আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হ্যাচর প্যাঁচর করতে করতে বালির উপর দিয়ে ছুটলাম ।


চতুর্থ ভাগ :

আমরা বালির উপর দিয়ে হাটতে হাটতে কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে উঠলাম । পিচ ঢালা বড় রাস্তার পাশেই আমাদের ট্রাভেলার পার্ক করা ছিল । সকলে লাইন দিয়ে ট্রাভেলারে উঠে যে যার পছন্দের সিটের দখল নিলাম । খানিক পর ট্রাভেলার টি চলতে শুরু করতে না করতেই জনগণ হাসি-ঠাট্টা খুনসুটিতে মশগুল হয়ে পড়ল । অমোঘ সবার হাতে হাতে এনার্জি বার এবং এনার্জি ড্রিঙ্ক বিলি করা শুরু করল । জিনিসগুলি মুঠোয় নিয়ে আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম । খাবার দাবার এর বহর দেখে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে আজ কপালে দুঃখ আছে । একবার উদাস মুখ করে দু হাঁটু তে আলতো করে হাত বোলালাম । বিড়বিড় করে বললাম ভালো থাকিস তোরা । তারপর ট্রাভেলারে র ছাদের দিকে চেয়ে হুমমম করে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম । এই সবের ফাঁকে আড়চোখে একবার পাশে বসা নন্দিনীর দিকে তাকালাম । সে তখন হাতের এনার্জি বারের প্যাকেট খুলে ভেতরের আধ গলা বস্তুটি মুখে পুড়ে এ গাল ও গালে ম্যানেজ করতে মশগুল । প্রায় পাঁচ ছয় কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করার পরে হাতের বা পাশে গডস ওন বিচ দেখতে পেলাম । জিনিসটা দেখে একেবারেই সমুদ্র মনে হয় না , বরং খানিকটা ব্যাক ওয়াটার ধাঁচের । আমাদের ট্রাভেলার গডস ওন বিচে থামেনি বরং আরো খানিকটা চলার পরে সকাল সোয়া দশটা আমরা বেলেকান বিচে এসে পৌঁছলাম। বেলেকান বিচ আমাদের ট্রেক অভিযানের স্টার্টিং পয়েন্ট । বিচটি আয়তনে ছোট কিন্তু অপরূপ সুন্দর । সমুদ্রের ঢেউ তেমন নেই ,খানিকটা নদীর মতো স্রোত আছে। বিচের পাশে কাঁচা লাল মাটির রাস্তা সোজা গিয়ে সামনের জংলা পাহাড়ে উঠেছে । বিচ টা বালির হলেও আশেপাশে প্রচুর ছোট বড় মাঝারি এবড়োখেবড়ো পাথর ছড়ানো, যদিও সমুদ্রের দুর্বল জলের স্রোত সেই পাথর অব্দি এসে পৌঁছাচ্ছে না। চারপাশে তাকিয়ে শুধু একটা একচালা কুঁড়েঘর তার গায়ে হেলান দেওয়া একটা বাইসাইকেল আর কয়েকটা নারকেল গাছ ছাড়া আর সেরকম কিছু চোখে পড়লো না । আজকে আকাশ ফুটফুটে নীল । এক বিন্দু মেঘের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও । দূর থেকে দেখলে মনে হবে আকাশটা যেন চওড়া হতে হতে সমুদ্রে এসে মিশেছে । শুধু দুটো বস্তুর পার্থক্য বোঝাতে কেউ যেন আকাশ ও সমুদ্রের মধ্যে খানে একটি নীল রং মাখা তুলি জলে গুলে হালকা টান দিয়েছে ।


বেলেকান বিচ

খানিকক্ষণ সৌন্দর্য উপভোগ করার পরে আমরা পায়ে পায়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম । প্রথমে অমোঘ , মাঝে হার্ষিতা আর শেষে বিপুল আমাদের গার্ড অফ অনার দিয়ে নিয়ে চলল । যেটা কে এতক্ষণ পাহাড় বলে মনে হচ্ছিল খানিকটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করতেই সেটাকে টিলা বলাই শ্রেয় মনে হলো । তবে জিনিসটা যথেষ্টই খাড়া । শুরুর দিকে রাস্তা খানিকটা চওড়া হলেও যত গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলাম রাস্তা সরু হতে লাগলো ।


সবাই হাটি হাটি পা পা করে একে অপরের পেছনে হেঁটে চললাম

এখানেও মাটির রং লাল , জায়গায় জায়গায় বাদামী পরোদ এবং রুক্ষ । কয়েক জায়গায় এবড়ো খেবড়ো পাথরের কারণে সিঁড়ির ধাপের মতো তৈরি হয়েছে । জঙ্গলের মাঝামাঝি পৌছে দেখলাম এক জায়গায় রাস্তা প্রায় মিলিয়ে এসেছে । দুটো লোক পাশাপাশি হাটার জায়গাটুকু অবধি নেই । সুতরাং সবাই হাটি হাটি পা পা করে একে অপরের পেছনে হেঁটে চললাম । আমার পেছনে থাকা বিপুল কে জিজ্ঞেস করে জানলাম আমরা চলেছি প্যারাডাইস বিচে । নিচের দিকে আরেকটু নামতেই মুখে তুলে দেখি সামনে সমুদ্রের জলের রেখা দেখা যাচ্ছে । তবে এখান থেকে রাস্তা অতীব দুর্গম এবং ঢালু । একচুল এদিক ওদিক হলে সোজা 100 ফুট নিচে । অনেকে আবার হাতের দুপাশের পাথুরে টিলার খাঁজে হাত দিয়ে বসে বসে নামতে শুরু করল । নন্দিনীর অবস্থাও তথৈবচ । একবার তো পা ই ফসকে গেল । কোনরকমে আমার হাত ধরে আর পাথরের খাঁজে সাপোর্ট দিয়ে সামলালো । এইভাবে এক প্রকার নিঃশ্বাস বন্ধ করে গুটি গুটি পায়ে টেনে হিঁচড়ে পাহাড় থেকে নামার পর প্যারাডাইস বিচ দেখতে পেলাম । শেষের দুটো পাথর উত্তেজনার বশে লাফিয়ে নামলাম ।



প্যারাডাইস বিচ আয়তনে বেশ ছোট । জায়গায় জায়গায় বড় বড় বোল্ডার সমুদ্র থেকে মাথা উচিয়ে আছে । কয়েকটা সার দেওয়া নারকেল গাছ দেখতে পেলাম । দুটো লোক তার নিচে বসে খাওয়ার জল ও ডাব বিক্রি করছে । খানিক দূরে একটা ছোট পাথরের ওপর কয়েকজন জটাধারী শ্বেতাঙ্গ শুয়ে বসে ছিলিম টানছে এবং জায়গাটা ধোয়ায় ধোয়াকার । আমার ভারী লোভ লাগছিল কিন্তু ধরা পড়লে বে ইজ্জতির ভয়ে আর নিজের মনকে প্রশ্রয় দিলাম না । ধরা পড়লে মানে আমাদের ট্রেক অভিযান সম্পূর্ণ স্মোক, আলকোহল এবং লিটার ফ্রি । মানে ধূমপান, মদ্যপান আর যত্রতত্র নোঙরা ফেলা ভীষণ ভাবে নিষিদ্ধ । ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ ট্রেক থেকে বহিস্কার । তাই মুখটা কাঁচুমাচু করে গালে হাত বুলোতে বুলোতে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম ।


Gokarna Picture
প্যারাডাইস বিচে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসিনী।

একটা কুকুরও দেখতে পেলাম যেটার চলন বলন দেখে মনে হল সেও প্রসাদের ভাগ পেয়েছে । আমাদের কো-অর্ডিনেটর রা জানালো আমরা এখানে আধঘন্টার বিরতি নেব , সুতরাং আগ্রহীরা জনগণ যেন তাদের জল কেলি পর্ব এখানেই মিটিয়ে নেয় । কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার কানের পাশ দিয়ে শাহরুখ ,আয়ুষ আর অনুভব ছুটে গিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল । আমি ওইসব রাস্তায় না হেঁটে একটু আশপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম । অদ্ভুত সুন্দর জায়গা । তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা । কোনদিকে সমতল রাস্তা নেই আসা যাওয়ার । যেদিক থেকেই বিচে আসো না কেন , পাহাড় না ডিঙিয়ে উপায় নেই । এই দুর্লভ মন ভোলানো পরিবেশ এর জন্যই হয়তো এর নাম প্যারাডাইস । দু এক জায়গা থেকে পাথরে চড়ে সমুদ্র দেখলে বিদেশ বলে ভুল হয় । দূরে দেখলাম আর একটি টিলার ওপর বসে এক শ্বেতাঙ্গিনী গভীর ভাবে ধ্যানমগ্ন । কয়েক জায়গায় পাথরের গায়ে স্প্রে পেইন্টিং এর গ্রাফিক্টি দেখতে পেলাম । প্যারাডাইস বিচে সমুদ্রের ঢেউ খানিক বেশি , অন্তত বোল্ডারের গায়ে জলের আছড়ে পড়ার আওয়াজ শুনে সেরকমই মনে হয় । জলের দিকে চেয়ে দেখলাম আমাদের দলের বেশ কয়েকজন সাঁতার কেটে প্রায় অনেক দূর চলে গেছে । সূর্য এখন মধ্যগগনে । সমুদ্র টা মনে হচ্ছে রুপোলি রাংতায় মোড়ানো । জায়গায় জায়গায় সূর্যের সোনালী আলো রাংতার গায়ে জড়িয়ে রাখা জরির সুতোর মত চিক চিক করে উঠছে । মিনিট পনেরো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর হাওয়ার তেজ বাড়লো । আমি ইতিমধ্যে দুটো শাঁসালো ডাব সাবার করে নন্দিনীর হরেক রকম পোজ দেওয়া ছবি তুলে দিয়েছি । মাথায় পেল্লায় টুপি দিয়ে, জলে পা ভিজিয়ে, পাথরের উপর আধশোয়া হয়ে, আরও না না রকম । এর মধ্যেই রশ্মী ও আমাকে দিয়ে তার বেশ কয়েকটা ছবি তুলিয়েছে এবং বা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আমার আর নন্দিনীর একটা ছবিও তুলে দিয়েছে ।এই ভাবেই আরো কিছুক্ষণ কাটলো । সবাই একে একে জল থেকে উঠে পরে, গা হাত পা মুছে চুলটুল আচরে আবার যে যার মত তৈরী হলো । পথের একরাশ ক্লান্তি আর জামায় লেগে থাকা ঝুর ঝুরে বালি আপাতত ঝেড়ে ফেলে আমরা রওনা হলাম হাফ মুন বিচের দিকে ।

পঞ্চম ভাগ :

যেখানে সমুদ্র শেষ হয় বালির দাগ দেখা যেতে শুরু করেছে সেখান থেকে কয়েক হাত দূরে একটা অস্থায়ী দর্মার বেড়া দেওয়া বিচ ক্যাফে । সেখানে এখন উপচে পড়া ভিড় । একটা ছেলে ক্রমাগত লেবু পিষতে পিষতে সোডার বোতল খুলে চলেছে । আরেকজন সমানে গ্লাসে চামচে গুলে ট্যাং ট্যাং শব্দ করে লাইম সোডা বানিয়ে সামনে বাড়ানো অগুনতি হাতে বিলিয়ে চলেছে । আমি আমার সোডার দ্বিতীয় গ্লাসটায় একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে মৃদু আহ শব্দ করলাম । আমার কিছুটা দূরে নন্দিনী মাথার টুপিটা হাঁটুর ওপরে রেখে হাত পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে । আমাদের দলের বাকিরাও তখন লাইম সোডা তে ডুবে । এই বিচ ক্যাফে টি হাফ মুন বিচে । আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি মিনিট কুড়ি আগে ।



প্যারাডাইস বিচের থেকে আমরা আবার পাহাড় ,থুরি পাথরে চড়তে শুরু করেছিলাম । বালির উপর পেল্লায় পেল্লায় পাথর দেখে মনে হয় কেউ একটা পাহাড় কে ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে সেগুলিকে একটার উপর একটা সমানভাবে বসিয়ে রেখে গেছে । পাথরের গায়ে প্রকৃতির বিস্তর ঘষামাজা থাকার ফলে জায়গায় জায়গায় খাজ তৈরি হয়েছে । সুতরাং সাবধানে পা ফেলে চলতে থাকলে সেরকম কোনো অসুবিধা হয় না । একটা দুটো তিনটে করে পাথর পেরোনোর পর রাস্তাটা খানিকটা খাড়াই হতে শুরু করল । আরেকটু যেতেই দেখলাম সামনে আরেকটা ছোটখাটো পাহাড় বুক চিতিয়ে মিলিটারি পোজে দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষায়মান । ভাবখানা এমন , এসো না এসো , আমায় ডিঙিয়ে দেখাও তবে বুঝি । তা যাই হোক পাথুরে রাস্তা হলেও বেশ মসৃণ । সুতরাং এখানেও হাঁটতে সেরকম বেগ পেতে হলো না । আমাদের ডান দিকে পাহাড় আর জঙ্গল আর বাঁ দিকে অতল সমুদ্র । সমুদ্রের সেই অপরূপ শোভা নিজের চোখে না দেখলে ভাষায় ব্যক্ত করা অত্যন্ত কঠিন । কয়েক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে ছোট বড় মাঝারি মাপের নারকেল গাছ । দূর থেকে দেখলে মরুভূমির ওয়েসিস বলে মনে হয় । আকাশ পরিষ্কার এবং মেঘ মুক্ত থাকার দরুন সমুদ্রের জল টাও ভীষণরকম নীল । আরো খানিকটা চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে দূর থেকে হাফ মুন বিচ দেখতে পেলাম । বিচটি অর্ধ চন্দ্রের মত গোলাকার । সামনে থেকে দেখে সে ভাবে বুঝতে না পারা গেলেও একটু দূরে পাহাড়ের উপর থেকে হাফ মুন এর সেপ টা খুব সুন্দর ভাবে বোঝা যায় । হাফ মুন বিচে পাহাড় বেয়ে নামতে খুব একটা অসুবিধে সম্মুখীন হতে হয়নি আমাদের । প্যারাডাইস বিচ এর তুলনায় এই বিচে পৌঁছানোর রাস্তা অনেক সহজ । আমাদের সবারই খাওয়ার জলের বোতল খালি । এমত অবস্থায় হাফ মুন বিচে লাইম সোডা বিক্রি হতো দেখে সকলেরই ধরে প্রাণ এলো । ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে আশপাশটা ঘুরে দেখছিলাম । হাফ মুন বিচ প্যারাডাইস বিচের মতই আয়তনে ছোট । বিচের বেশিরভাগটাই নুড়ি পাথর আর বোল্ডার বিছানো । সোডা পান পর্ব মিটিয়ে আমরা বালির ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম । ফেব্রুয়ারি মাস হলেও সূর্যের তেজ আর গরম মে মাস কেও হার মানায় । গোকর্ণর বিচ এর অনেকগুলোই শ্বেতাঙ্গদের দখলে। হাফ মুন বিচে রাশিয়ান আর ইজরাইলিদের ভিড় বেশি । কেউ বালিতে শুয়ে সানবাথ নিচ্ছে ,কেউ আবার পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে চলেছে আর কেউ বা ছোট ছেলেমেয়েদের বালির ওপরে গাছের ডাল দিয়ে আঁকিবুকি কেটে হাতে খড়ি দেওয়াচ্ছে । দু একজন বিদেশিকে মাঝ সমুদ্রে স্নান করতে দেখলাম । ওহ, আরেকটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি । আমরা যখন সকালে গোকর্ন মেইন বিচ থেকে হেঁটে আসছি তখন একজন বিদেশি ভদ্রলোককে দেখেছিলাম হাতে পাঁচটা বল নিয়ে জাগলিং এর চেষ্টা করতে । 5-6 বার চেষ্টা করতে দেখেছি কিন্তু না কখনোই দুবারের বেশী শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া বল হাতে ধরতে পারেননি । এখানেও একজনকে দেখলাম বল হাতে লোফালুফি করতে, কিন্তু এই ভদ্রলোকের পারফরম্যান্সও তার গোকর্ণ বিচের জাত ভাইয়ের মতই শোচনীয় । এরা বোধ হয় শিক্ষানবিস । লোফালুফি তে পটু হয়ে গেলে, দেশে ফিরে গিয়ে খেলা দেখিয়ে উপার্জন করবে । আমি আরো কয়েকবার দেখার পর বিরক্ত হয়ে নিজেই সরে এলাম । এত হাবিজাবি কথার মাঝে আরেকটা বড় জিনিসও বাদ পড়ে গেছে । সেটা বলি তবে । আমরা যখন মাঝ রাস্তায়, এক জায়গায় পৌঁছে দেখা গেল দাবানলের কারণে রাস্তা বন্ধ । জঙ্গলের বেশ অনেকটা জায়গা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে । আশেপাশের বেশ কিছু গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে । সামনে এগোনোর রাস্তাটা সাদা ধুলোর মতো ছাইয়ে পরিপূর্ণ । তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে গিয়ে দেখা গেল প্রায় গোড়ালি অবধি ছাই এর পুরু আস্তরণে ঢুকে যাচ্ছে । তাছাড়াও যা বুঝলাম আগুন নিভেছে খুব বেশিক্ষণ হয়নি। ছাই এর প্রলেপ যথেষ্ট গরম । সামনে এগোতে হলে প্রায় আধ কিলোমিটার পথ ছাই এর ওপরে হেঁটে চলতে হবে । অনেকেরই পায়ে ক্যানভাস বা রবারের ট্রেকিং সু । ছাইয়ের যা অবস্থা, ওটার ওপর দিয়ে পদব্রজে চলার চেষ্টা করলে জুতো এবং পায়ের ক্ষয় ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল । আমাদের মধ্যে বিপুল , অমোঘ, হার্শিতা ছাড়া সুরের ভালো রকম ট্রেকিং এক্সপিরিয়েন্ আছে । সুতরাং তিনজনে আলোচনা করে হাঁটার রাস্তা ঠিক করল খানিকটা এরকম । ছাইচাপা রাস্তাটির দুদিকে ফুট খানেক উঁচু ঢিবি রয়েছে । প্রথমে ডান দিকের ঢিবিতে একটা পা দিয়ে চড়ে আরেকটা পা বা দিকের ঢিপির ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অমোঘ । বিপুল ততক্ষণে এদিক ওদিক করে ঢিপির ওপর দিয়ে রাস্তার অপর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে । সুর ডান দিকের ঢিপিতে একটা পা এবং আরেকটা পা বা দিকের ঢিপি তে রেখে অমোঘের মতো কায়দায় জায়গাটার মাঝামাঝি এসে দাঁড়ালো । তারপর আমরা একে একে অমোঘ এর বাড়ানো হাত ধরে ঢিপিতে চড়ে ডান দিকের পায়ে বেশি ভর দিয়ে বাঁ দিকের পা টা যথাসম্ভব স্ট্রেচ করে বাঁ দিকের ঢিপির ওপর রেখে রাস্তার মাঝামাঝি অবধি ওইভাবে পৌঁছলাম । তারপর সেখান থেকে সুর আমাদের হাত ধরে বাঁ দিকের ওপর টেনে এনে ফেলে আরো খানিকটা এগিয়ে দিল । আমরা বাঁদিকে ওপর দিয়ে পড়ি কি মরি করে দৌড়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো বিপুলের হাত ধরে নেমে এলাম । একে একে সবাই রাস্তা পেরোতে অমোঘ এবং সুর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাকি রাস্তাটা অতিক্রম করে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো । কিন্তু তারপরও বিপত্তির আরও বাকি ছিল । দাবানল এর প্রকোপ যে ভালো রকমই ছিল সেটা বুঝতে পারলাম সামনে অগুনতি গাছের ডাল ও গুড়ি পড়ে থাকতে দেখে । রাস্তা পুরোটাই বন্ধ এবং ওই প্রকান্ড গাছের গুড়ি গুলো আর ডালপালা সরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব । সবাই যখন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে তখন বাঁ দিকের ঝোপঝাড় ঠেলে কোথা থেকে এক বুড়ির আগমন । বুড়ি বয়সের ভারে ন্যুব্জ , চামড়া দলা করা কাগজের মত কুঁচকানো, মাথায় সাদা ফেনার মত চুল, ময়লা তামাটে গায়ের রং। কানে মাকরি, নাকে চওড়া নাকচাবি, গলায় বেড়ির মত মোটা হার । বুড়ি আমাদের কাছে এসে খোনা গলায় কন্নড় ভাষায় অমোঘ এর সাথে কি সব কথা বলল । কথাবার্তা পর্ব মেটার পর অমোঘ আমাদের জানালো ঝোপঝাড়ের পিছনে বুড়ির কুঁড়েঘর এবং সেখান দিয়ে নিচে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছানোর রাস্তা আছে । তবে শর্ত একটাই, এই রাস্তা ব্যবহার করতে গেলে বুড়িকে পর্যাপ্ত পরিমাণে রোড ট্যাক্স দিতে হবে । অন্য কোন উপায় না থাকায় আমরা সকলে তাতেই সম্মতি জানালাম । বুড়িকে শ'পাঁচেক টাকা দেওয়ার পর সে আমাদের ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে খানিক দূর এগিয়ে দিল । নিচে নামতে নামতে বুড়ির কুঁড়ে ঘর দেখতে পেলাম । আরেকটু নেমে প্রায় সমতল জমিতে আসতে কিছু চারকোনা ক্ষেতের দিকে চোখ গেল । কিসের ক্ষেত বোঝা গেল না । আমরা সেই শুকনো ক্ষেত এর আলের ওপর দিয়ে হেঁটে আরেকটা উঁচু ঢিবির ওপরে এসে উঠলাম । ক্ষেতে দুটো কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল , তারাও খানিক দূর আমাদের পেছনে পেছনে লেজ নাড়তে নাড়তে এলো । ঢিবি টাতে চড়তেই হাফ মুন বিচ দেখা গেল । সেখান থেকে নিচে নামার বর্ণনা উপরেই দিয়েছি ।

আমরা হাফ মুন বিচ ছাড়িয়ে এগিয়ে এসেছি বেশ কিছুক্ষণ । এখনো পর্যন্ত পথে বলার মতো উল্লেখযোগ্য সে রকম কোন ঘটনা ঘটেনি । আমাদের বিচ অভিযান পর্বের চতুর্থ বিচের অর্থাৎ ওম বিচের অভিমুখে চলেছি আমরা। কেন এই বিচার নাম ওম এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা আগামী ভাগের জন্য তোলা থাক ।চারপাশ জানান দিচ্ছে এখন ভরা দুপুর । খিদেও পেয়েছে প্রচন্ড । মুখের সামনে রোদ্দুর থাকায় চোখ নাক কুঁচকে পেট চেপে ধরে কুজো হয়ে এগিয়ে চলেছি ।


ষষ্ঠ ভাগ :

প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গেল খাবার টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে আছি । আমাদের এখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি । খাবার অর্ডার দিয়েছি সেই কখন । এখনো অব্দি তা আসার কোন নাম গন্ধ নেই । ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলে তার সেই একই কথা, ধৈর্য ধরে বসুন ,ভালো জিনিস তৈরি হতে সময় লাগে । আমরা এখন রয়েছি ওম বিচের নির্ভানা কাফেতে । তিনটে টেবিলে ভাগ হয়ে বসা হয়েছে । একটা টেবিলে নন্দিনী আর আমি । আরেকটাতে লিনফোর্ড আর এনেট । আর সোফা ওয়ালা সব থেকে বড় টেবিলটায় বসে আছে বাকিরা । আমাদের তিন ট্রিক কো-অর্ডিনেটর সমুদ্রের বেস্ট ভিউ টা পাওয়ার জন্য দো তলায় বসেছে । লিনফোর্ড রা সাউথ ইন্ডিয়ান মিল অর্ডার করেছিল । আড় চোখে ওদের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি এনেটের খাওয়া হয়ে গেছে আর লিনফোর্ড কষের দাঁত দিয়ে চোখ বুঝে পেল্লাই সাইজের মাছ ভাজা চিবোচ্ছে । বড়ো টেবিলটার অবস্থা আমাদেরই মত । দুতিনজন তো হাত পা ছড়িয়ে শুয়েই পড়ল দেখলাম সোফাতে । নন্দিনী বিরক্ত মুখে উসখুস করছে আর আমি আমার মনকে বুঝিয়ে চলেছি, ধৈর্য রাখ বৎস প্লেটের উপর চিকেন টা পরলো বলে । অবশেষে আরও আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর খাবার এলো । নন্দিনীর গ্রিলড কিং ফিস আর আমার চিকেন স্প্যাগেটি ইন মাশরুম সস । খেতে খেতে একটু ওম বিচের বৃত্তান্ত টা বলে নেওয়া যাক । বিচ টার নাম ওম তার কারণ টিলার উপর থেকে দেখলে বিচটা কে হিন্দু ওম কার এর মত দেখায় । না ব্যাপারটা বিশেষ কিছুই নয় । ধরা যাক একটি গোলাকার বিচ , তার মধ্যে খানে লম্বা লাইন দেওয়া বোল্ডারের সারি সমুদ্রের পেট চিড়ে উকি মারছে । বোল্ডার গুলোর ওপর খানিকটা শ্যাওলা ও জংলি ঘাসপাতা জন্মেছে । দূর থেকে খালি চোখে দেখলে ঘাস পাতা সমেত পাথরগুলো ছোট ছোট দ্বীপের মতো লাগে। প্যারাডাইস আর হাফ মুন বিচের তুলনায় এইখানে লোকজনের আনাগোনা বেশি । বিদেশিদের আনাগোনাও যথেষ্টই ।



এই সব কিছুর মধ্যে কোন রকমে আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হল । বেলা সাড়ে তিনটের মধ্যে আমাদের কুডলে বিচের দিকে হাঁটা লাগানোর কথা ছিল, কিন্তু লোকজনের খাওয়া দাওয়ার বহর দেখে ঘড়িটা খুলে রাখলাম হাত থেকে ।টেবিলে বেছানো ঘড়ির কাটা যখন প্রায় চারটে ছুঁই ছুঁই তখন বেশিরভাগ লোকেরই খাওয়া-দাওয়া শেষ। কেউ টিস্যু পেপারে হাত মুছছে , কেউ বেসিনে মুখ ধোয়ার লাইনে ,কেউ বা কাউন্টারে বিল । নন্দিনীর ও খাওয়া হয়ে গেছে , টিস্যু পেপারে আঙ্গুল সাফ করতে করতে হেউ হেউ করে গতকতক ঢেকুর তুলল আমার কানের কাছে। বোধহয় ঘড়িটা পরে নিতে বলল , এবার উঠতে হবে । চারটে নাগাদ আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম । এতক্ষণে চারপাশের আবহাওয়া একটু ঠান্ডা হয়েছে । মৃদু বাতাস বইছে সমুদ্র দিক থেকে । রোদ্দুরের তেজও এখন খানিকটা কম। ছোট ছোট পা ফেলে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগছে । বিচের ওপর মাছ ধরার নৌকা দেখতে পেলাম রংবেরঙের । সেগুলোর গায়ে হরেক রকম হরফে লেখা ও ছবি আঁকা । নৌকা গুলোর আশেপাশে কিছু লোকজন ছোটা ছুটি করছে, একদল জেলেপাড়ার ছেলে ভলিবল খেলতে ব্যস্ত। দু একজন ফেরিওয়ালা ও দেখলাম বেলুন , ছোটদের খেলনা ইত্যাদি সামগ্রী নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে । ওম বিচের শেষ প্রান্তে কিছু জামা কাপড় ও প্রসাধনীর দোকান । জায়গা টা পুরীর স্বর্গদ্বার গোছের দেখতে । দোকান গুলোর পাশে পাথরের বড় বড় সিঁড়ির ধাপ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে খানিকটা চলার পর উপর থেকে পিছন ফিরে তাকালাম । ছোট ছোট টিলা ,পাথর আর বালুরাশি তে সাজানো ওম বিচ অপরূপ সুন্দর দেখতে লাগছে । দূর থেকে বিচ ক্যাফে আর শ্যাক গুলো দেখে মনে হচ্ছে ছোট ছোট দেশলাই বাক্স সুন্দর করে কেটে সেগুলো দিয়ে ঘর বানিয়ে কেউ বসিয়ে রেখে গেছে । সিঁড়ির ধাপ শেষ হওয়ার পর আবার খানিকটা পাথুরে রাস্তা , তবে প্রায় সমতরাল, হাঁটতে অসুবিধা হয় না সেরকম । সেই রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার মত হেঁটে বড় রাস্তায় এসে উঠলাম । অনেকক্ষণ পর চওড়া পিচঢালা রাস্তা এবং তার ওপর দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি ঘোড়া দেখে বেশ ভালোই লাগলো । মনে হল এতক্ষণ যেন সভ্যতার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন ছিল । রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকের মেঠো ঘাস জমিতে এসে পড়লাম । বড় বড় ঘাস আর বুনো ফুল গজিয়ে রয়েছে । সেই ঘাসের ওপর দিয়ে আবার কিছুটা পথ হেঁটে যেতেই সিঁড়ির ধাপ চোখে পরলো। সেই সিঁড়ি ধরে নেমে গেলে কুডলে বিচে পৌঁছব । সিঁড়ির সামনে ঠান্ডা পানীয়ের দোকান । সেখানে বিশ্রাম নেওয়ার অছিলায় দাঁড়িয়ে এক প্রস্ত ডাবের জল কোল্ড ড্রিংক ইত্যাদি খাওয়া দাওয়া চলল । বাঙালি বলে খাই খাই বেশি এই বদনাম আর কেউ দিতে পারবে না একথা ভেবে খুশি লাগলো বেশ। বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে সকাল থেকে গান্ডে পিণ্ডে গিলে চলেছে । আসলে এতটা পথ হেঁটে সবারই খিদের চরমে এবং প্রত্যেকেই যা পাই তাই খাই গোছের মুডে । জল টল খেয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম । লিনফোর্ড, এনেট আর হর্ষিতা একটু আগে আগে চলছিল । ওরা হনহন করে হেঁটে বেশ কিছুক্ষণ আগে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে । আমি আর নন্দিনী ওদের পেছনে পেছনে আসছিলাম । একটা বাঁক ঘুরতেই দেখতে পেলাম ওরা তিনজন একজন পুলিশ কর্মীর সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ে জড়িয়ে পড়েছে । এরকম জায়গায় পুলিশ একেবারেই আশা করিনি, খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম বলাই বাহুল্য । ঘাড় ঘুরিয়ে নন্দিনীর দিকে চেয়ে দেখি বেচারি হামমম শব্দ করে একটা প্রকান্ড হাই তুলতে মুখ খুলেছিল কিন্তু হঠাৎ পুলিশ দেখে তার হাই টা ফসকে গেছে এবং মুখ বন্ধ করার কথাও তার মাথা থেকে বেমালুম লোপ পেয়েছে । মুখ টা বন্ধ কর, নন্দিনীকে অস্ফুটে বলে , হর্ষিতার কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে জানলাম যে পুলিশকর্মী টি ওদের ব্যাগে মাদকদ্রব্য আছে ভেবে সকলের তল্লাশি চালাতে চাইছে । এই বিষয়ে জানিয়ে রাখি গোকর্ন এর গাঁজা বিখ্যাত । হিমাচলের মালানা গ্রামে ভারতবর্ষের সবথেকে উৎকৃষ্ট মানের গাঁজার চাষ হয় । গোকর্ন র গাঁজার স্থান তার পরেই । এখানে বিদেশিদের যত্রতত্র গাঁজা র ছিলিম বা জয়েন্ট হাতে দেখা যায় । ওরা যেহেতু ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের আওতার বাইরে , আইন কানুন ওদের জন্য যথেষ্ট শিথিল । যত ধর পাকড় ভারতীয় দেখলেই । আমরাই বা বাদ যাবো কি করে । ধীরে ধীরে দলের বাকিদের ও এসে আমাদের সাথে যোগ দিতে এবং আমাদের দল ভারী হতে দেখে পুলিশকর্মী টি ফোন করে তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের ডাকলো । বেশ খানিকক্ষণ কথা কাটাকাটি , বাক-বিতণ্ডার পর আমাদের পিছু হটতেই হল । ওরা একে একে সবার ব্যাক চেক করলো এবং যারপরোনাই শুকনো মুখে আমাদের আগে এগিয়ে যেতে বলে সামনের দিকে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো নতুন শিকারের আশায় । যেখানে পুলিশের ছিল সেখান থেকে দু ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নামলে একটা দাঁড়ানোর জায়গা আছে , সেখানে পৌঁছে কুডলে বিচ দেখতে পেলাম । কুডলের সমুদ্র ঠিক দুটো পাহাড়ের মাঝখানে ভেসে রয়েছে যেন এবং গাঢ় সোনালী রঙের সূর্যটা ক্রমেই বাঁ দিকের পাহাড় টার গায়ে ঢলে পড়ছে । এখানে সূর্যদয় বেশ বেলা করেই হয় এবং সূর্যাস্তের সময় ও বেশ দেরিতেই । সুতরাং সানসেট এর এখনও বেশ খানিকটা দেরি আছে ভেবে আশ্বস্ত হলাম । আর একটা জিনিস ভেবে ও মনটা বেশ খুশি খুশি লাগলো যে আমরা ট্রেকিং এর কঠিন পথ সবটাই পেরিয়ে এসেছি সামনে আর কোন পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়ার গল্প নেই । পুরোটাই সিঁড়ি লোকালয় এবং পিচ ফেলা পাকা রাস্তা । কিন্তু অদৃষ্ট হ্যাড আদার প্ল্যান্স । নন্দিনী আমার পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছিল । আমি হাতটা বাড়িয়ে খপ করে ওর ডান কবজি টা চেপে ধরলাম । ও মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পনে নীচে নামছিল। হাতে টান পরতেই একটু হকচকিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো। আমি ওর কবজি টা আরেকটু চেপে ধরে বললাম এই যে সূর্যের আলোটা দেখছিস, এটাকে কনে দেখা আলো বলে জানিস ! নন্দিনী ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো । পাহাড়ের গায়ে কোণঠাসা সূর্যের আলো টা পুরোটা ওর মুখে এসে পড়ে মুখটা রাঙিয়ে দিয়েছে ।


সপ্তম ভাগ :

কুডলে বিচে সন্ধ্যা নামছে এখন । সূর্য টা একটু একটু করে পাহাড়ের কোন ঘেষে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছে । একটা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে গোটা সৈকত জুড়ে। না চোখ ধাঁধানো বা উজ্জ্বল আলো নয় এটা , মলিন , নিভন্ত , চোখ জুড়ানো অথচ মন খারাপ করা একটা আলো । এমন মায়াময় সূর্যাস্তের একটুখানি বর্ণনা না দিলে ঘোরতর অন্যায় হবে । বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সূর্যটা ধীরে ধীরে সোনালী খোলস ছেড়ে লালচে হতে শুরু করলো । প্রথমে হালকা লাল আভা তারপরে গাঢ় কমলা ও লালের মিশেল হয়ে তারওপর আরেক পরোদ আলতার মত টকটকে লাল রং এবং সবশেষে লাল রং টা ফিকে হতে শুরু । মনে হবে কেউ যেন পাতার রং টা শুকোনোর আগেই তাতে জল ঢেলে ঘেঁটে দিয়েছে । লাল রং টা যখন একদম হালকা হয়ে এসেছ পুরো আকাশের গায়ে তখন একটা লালচে গোলাপী আভা , ঠিক যেন তুলি টেনে টেনে পাতায় ঢালা জলটা শুষে নেওয়ার চেষ্টা চলছে । দূরে মাঝসমুদ্রের জলটা কালছে দেখাচ্ছে আর বিচের ওপর আছড়ে পড়ে ঢেউ গুলো থেকে একটা ভেজা সোনালী রঙ ঠিকরে বেরোচ্ছে । সূর্যের চারপাশটা দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ এক মুঠো সিঁদুর উড়িয়ে দিয়ে গেছে ওটার গায়ের উপর । আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখান থেকে সূর্য টা খুব ছোট দেখা যাচ্ছিল । সামনে কিছু ছেলে ভলিবল খেলছে , কিছু বিদেশি লোকজন ছোটাছুটি করছে । লোক গুলোর চেহারা ভালো করে বোঝা যায় না , সবাই কে কিরকম অদ্ভুত কালচে দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে লাল কমলা হলুদ মেশানো ক্যানভাসে কোন বাচ্চা ছেলে একটা গোল আর তিনটে দাগ টেনে হাত পা মাথা ওয়ালা মানুষের জিওমেট্রিক অবয়ব এঁকে গেছে । ক্রমেই সূর্যটা ঢলতে ঢলতে পাহাড় আর সমুদ্রের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল একেবারে । শুধু আকাশের গায়ে জানান দিয়ে গেল তার চলে যাওয়ার কথা । আকাশটা বেশ কিছুক্ষণ বিষণ্ন গোলাপি আভায় আলোকিত হয়ে রইল । যত অন্ধকার নামতে লাগলো আকাশটা ক্রমে হলুদ থেকে লাল হয়ে গোলাপি এবং শেষমেষ বেগুনি রং মেখে হঠাৎ নিভে গেল । তারপর ঝুপ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল । সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে অদ্ভুত ভাবে কোলাহল বেড়ে উঠল আশেপাশে । ক্যাফেগুলোতে নিয়ন এবং টুনি বাল্ব জ্বলে উঠতে লাগলো একে একে । যারা এতক্ষণ বিচে খেলাধুলো , ছুটোছুটি করছিল তারা সবাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি বা হোটেলের দিকে হাঁটা দিলো । কয়েকজন চাদর বিছিয়ে শুয়ে ছিল তারা উঠে পড়ে জামা কাপড় ঝেড়ে চাদর ভাঁজ করে বাড়ির পথে হাঁটা লাগালো । আমাদের গ্রুপের কয়েকজন বসে গিটার বাজিয়ে গান করছিল আর বাকিরা যারা ডুবন্ত সূর্যের হাতছানি অনুসরণ করে প্রায় সমুদ্রের হাটু জলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সন্ধ্যে নামতে না নামতে তারাও যে যার মত ফিরে এলো ।



আমরা কুডলে বিচে পৌঁছই প্রায় পাঁচটা নাগাদ । প্রথমে কথা হয়েছিল যে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা যাবো বিচ লাগোয়া সানসেট পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখতে । কিন্তু এত দূর হাঁটাহাঁটি করে সকলেই ক্লান্ত , বিশেষ কেউ ই সানসেট দেখার জন্য আবার পাহাড় চড়তে রাজি হল না । অগত্যা প্ল্যান ক্যানসেল করা হলো এবং ঠিক হল আমরা সন্ধে না হওয়া পর্যন্ত কুডলে বিচেই শুয়ে , বসে , চড়ে বেড়িয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করব যে যার মত । তারপরেই আমাদের দল টা তিনটা ভাগে ভেঙে গেল । একদল গিটার বাজিয়ে গান গাইতে বসল , এক দল বালির ওপর হাঁটু মুড়ে বসে বিশ্রাম নিতে লাগলো আর বাকি আরেকদল সমুদ্রের দিকে হাঁটা লাগালো । আমাদের ট্রেক অভিযানে যে সমস্ত বিচ গুলো ঘুরে দেখা হলো তার মধ্যে কুডলে বিচ ব্যস্ততম । এখানে পর্যটকদের আনাগোনা অত্যন্ত বেশি, সমস্ত জায়গাটাই কোলাহলে মুখর । বিচ এর পরিবেশ মনোরম হলেও দুদণ্ড শান্তি তে বসে তা উপভোগ করার জো নেই । এই কানের পাশ দিয়ে কেউ চিৎকার করে যাবে তো পরক্ষণে পিঠের ওপর লাথি খেয়ে ছিটকে আসা ফুটবল ধাক্কা মারবে । সুতরাং খানিকক্ষণ বসার পর বিরক্ত হয়ে জায়গাটা হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখাই মনস্থির করলাম । এতক্ষণ হাঁ করে সূর্যাস্ত দেখছিলাম , এবার সবাই একে একে এসে দলে যোগ দিতে আবার আমাদের চলা শুরু হলো । এবার ঘরে ফেরা । বড় রাস্তা ধরে হেঁটে শহরের মধ্যে দিয়ে আমরা আবার গোকর্ণ মেন বিচে গিয়ে উঠব তারপর হোম স্টে রাত্রি বাস এবং ক্যাম্প ফায়ার । বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চলতে চলতে লক্ষ্য করলাম অন্ধকার হওয়ার পর সমুদ্রের তর্জন-গর্জন অনেক বেড়ে গেছে । প্রায় চার ফুট সমান উঁচু ঢেউ গুলো বিচের ওপর আছড়ে পড়ে বালির ওপর বানানো ছোট ছোট স্যান্ডন্ ক্যাসেল আর নানান হরফে লেখা নাম ও ছবি ভেঙেচুরে দিচ্ছে । সবটাই যেন তার জিনিস , সকাল বেলা ব্যবহার করতে দিয়ে এখন দিনের শেষে আবার নিজের জিনিস নিজের ঘরে ফেরত নিয়ে চলে যাচ্ছে । সামনে অন্ধকার রাস্তা , সবাই যে যার সঙ্গের টর্চ বা মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম । কিছু জায়গায় সমান পিচের রাস্তা ও কিছু জায়গায় সিঁড়ি । অন্ধকার ছাড়া আর পথে সে রকম কোনো বাধা নেই সুতরাং চলতে অসুবিধা হয়না । সেখান থেকে এক কিলোমিটার চলার পর আমরা অন্ধকার সড়কে ওপর এসে পড়লাম । একটা ল্যাম্পপোস্ট অব্দি নেই কোত্থাও । দুদিকে ঘন জঙ্গল তার মাঝখানে পিচঢালা সড়ক এবং চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার । আমরা দলবল নিয়ে একপ্রকার অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে । আমাদের পথ চলায় সঙ্গত দিয়ে চলেছে আকাশে এক কোনায় ছোট্ট এক ফালি চাঁদ । কয়েকটা তারাও দেখা যাচ্ছে দূর আকাশে । আমরা ক্লান্ত বলেই হোক বা রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো না থাকার কারণেই হোক কিছুক্ষণ পর এই পথ চলা যেন দুরহ হয়ে উঠলো । সকলেই হতোদ্যম হয়ে পড়লাম । আর যেন হাঁটতে পারছে না কেউইশুধু আমাদের তিন ট্রেক কো-অর্ডিনেটর ছাড়া । একটু এগিয়ে গিয়ে সবার আগে হনহন করে হেঁটে চলা বিপুল শর্মা কে জিজ্ঞেস করে জানলাম আমাদের হোম স্টে এখনো সব মিলিয়ে প্রায় চার কিলোমিটারের হাঁটা পথ । নিজের মনে মনে হিসেব করে আন্দাজ করলাম হয়তোবা সবেমাত্র কিলোমিটার খানেক অতিক্রান্ত হয়েছে এতক্ষনে । নন্দিনী পাশ থেকে অন্ধকারে কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করল কিরে আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে ? আরো কিছুক্ষণ চলতে দূরে আলোর রেখা দেখা গেল । আলোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম আমরা শহরে প্রবেশ করছি । শহরে ঢুকতেই পিচের রাস্তা শেষ হয়ে পাথরের শান বাঁধানো রাস্তা শুরু হলো । একটা তিন মাথার মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরতেই দেখলাম বাজারে এসে পড়েছি । জায়গাটা বেশ জমজমাট । মুদি দোকান , সবজি মন্ডি , ঠেলা গাড়িতে ফুল ওয়ালা এবং অন্যান্য দোকান জুড়েজামাকাপড় প্রসাধনী সামগ্রীর পসরা । দোকানগুলোতে ভীড় যথেষ্টই । দেশি-বিদেশি সব রকম লোকজনই চোখে পড়ল । আরেকটা মোড় থেকে ডানদিক ঘুরতেই মহাবালেশ্বর মন্দির দেখতে পেলাম । কালকে এই মন্দির দর্শন করেই আমাদের গোকর্ণ পরিক্রমা শেষ হবে । মন্দির দেখে অনেকে দুই হাত জোড় করে নত মস্তকে প্রণাম ঠুকল । কেউ কেউ আবার কপালে আর গলায় ছোট করে আঙুলটা দুবার ছুঁয়ে নিয়ে অল্পে কাজ সারলো । মহাবালেশ্বর মন্দিরের গা দিয়ে সোজা হেঁটে যেতেই আবার অন্ধকার রাস্তা শুরু হলো । যেখানেশান বাঁধানো রাস্তার শেষ সেখান থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমরা গোকর্ন মেইন বিচে এসে পড়লাম । সামনের রাস্তা পুরোটাই বালির ওপর দিয়ে হেঁটে আমাদের হোমস্টে তে পৌঁছতে হবে । জায়গাটা বিচ্ছিরি রকমের অন্ধকার । কোথাও কোন জনমানব নেই এবং সমুদ্রের সৈকতের বালুরাশি টা অত্যন্ত রকম ফাঁপা । বালির উপর জায়গায় জায়গায় পায়ের চাপ পড়লেই প্রায় গোড়ালি অবধি ঢুকে যাচ্ছে বালিতে । আমি শরীর টা অর্ধেক ঝুঁকিয়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে বালির উপর দিয়ে সমুদ্রের ধারে চলে এসে বুঝতে পারলাম জায়গাটা সমুদ্র থেকে প্রায় তিন ফুট উঁচু । তুলনামূলক সমুদ্রের ধার টা বেশ সমান এবং হাঁটার জন্য উপযুক্ত মনে হল । বালিতে পা দিয়ে নামতে গিয়ে আরেক বিপত্তি । পায়ের নিচ থেকে হু হু করে সমস্ত বালি সরে গেল এবং মাটিতেএক প্রকার বসে পড়তে গিয়ে সামলে নিলাম নিজেকে । অন্ধকারে ডান পা টা আন্দাজ করে নিচে নামিয়ে দিতে এক জায়গায় শক্ত জমি পেলাম । সেখানে শক্ত করে পা টা রেখে হাওয়ায় শরীর টা ছুঁড়ে দিয়েলাফিয়ে পড়লাম সমুদ্রের দিকে মুখ করে । ধুপ করে একটা আওয়াজ হয়ে বালিতে স্মুদ ল্যান্ডিং হোল । তারপর সমুদ্রের ধারে বালির ওপর বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম । আমাদের দলের সবাই এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে নিজেদের হাঁটার গতিবেগ অনুযায়ী । পেছনে ঘুরে দেখলাম তিনজন পেছনে হেঁটে আসছে , একজন কে আবছায়া তে অমোঘ বলে ঠাহর করতে পারলেও বাকিদের অন্ধকারে মুখ বুঝতে পারলাম না । সামনেও দেখলাম কয়েকজন আমার থেকে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলেছে । জায়গাটা অন্ধকার হওয়া সত্ত্বেও বা দিকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে খানিকটা বোধগম্য হয় । আশে পাশের পুরোটাই আন্দাজ করে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই । অনেক দূরে কয়েকটা টিমটিম করে জ্বলা আলো দেখা যাচ্ছে । হয়তো ওই আলো গুলোর মধ্যে কোন একটা তে আমাদের পৌঁছতে হবে । মন শক্ত করে হেটে চলেছি ঠিকই কিন্তু কিভাবে এবং কবে গিয়ে ওই আলোর কাছাকাছি পৌঁছাব আমি নিজেও জানিনা । শেষ আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিট ধরে যেরকম হেটে চলেছি তাতে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করা হয়ে গেছে নিজের মনেই ভাবলাম । সমুদ্রের পাশ দিয়ে হাঁটছি বলে মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে গায়ের ওপর দিয়ে এটাই যা বাঁচোয়া । দম বন্ধ করা আবহাওয়া হলে এতক্ষনে পিঠের বস্তা টা খুলে রেখে এখানেই শুয়ে পড়তাম । এর মধ্যে হঠাৎ খেয়াল হলো নন্দিনী পাশে নেই । ডানদিক বাঁদিক সামনে পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না । পেছনে হেঁটে আসা ছায়া গুলোকেও দেখা যাচ্ছে না আর । সামনের লোক জনকেও দেখতে পাচ্ছি না । হঠাৎ মনে হলো এত বড় সমুদ্র সৈকতে আমি একা মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছি । কথাটা মনে হতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। আমি নন্দিনী নন্দিনী বলে হাক পাড়লাম কিন্তু না , কোন সাড়া শব্দ নেই কোথাও । সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই । একটা কুকুরের ডাক অবধি শোনা যাচ্ছে না , অথচ সকালেই ডজন খানেক সারমেয় ঘুরতে দেখেছি গোকর্ন বিচে । আমি ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে চার পাশটা আরেকবার ভালো করে দেখলাম । অত বড় সমুদ্র সৈকত , ফোনের আলোতে প্রায় কিছুই দেখতে পেলাম না , শুধু সামনে বালিতে একটা সাদা দাগ পড়ল মাত্র । আমি খানিকটা পেছনের দিকে হেঁটে গেলাম কিন্তু কিছুই দেখা গেল না । বালির ওপর দিয়ে কিছুটা সামনের দিকেও এগোলাম, তাও কাউকে দেখতে পাচ্ছি না । হঠাৎ মনে হল আমি রাস্তা হারিয়ে ফেললাম না তো ! ভাবমাত্র ই আমার হাতদুটো কিরকম অবশ হয়ে গেল । শিগগিরই সমুদ্রের পাড় থেকে সরে এসে আবার উঁচু বালির উপর পা দিয়ে ধস্তাধস্তি করে উপরে উঠে এলাম । গা হাত পায়ে বালিতে মাখামাখি হলো । একটু ধাতস্থ হয়ে ফের ডান দিকে তাকালাম । নাহ , কোথাও কেউ নেই । দুটো হাত মুখের পাশে জড়ো করে নন্দিনী ,নন্দিনী , বলে আরো কয়েকবার কোন চিৎকার করে ডাকলাম । এবারও কোন সাড়াশব্দ নেই । এতক্ষনে আমি রীতিমতন নার্ভাস হয়ে গেছি । দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি বেশ বুঝতে পারছি , ভালো মন্দ জ্ঞান লোপ পেতে শুরু করেছে । বেশ কয়েকবার ফোন করতে চেষ্টা করলাম ওকে । ফোনে টাওয়ার এর লেশমাত্র নেই । বিরক্ত হয়ে ফোনটাকে তিন-চারবার হাতের চেটোর উপর বাড়ি মারলাম । আমার বাড়ি মারার কারনেই কিনা জানিনা দেখলাম ফোনের টাওয়ারের দুটো ছোট ছোট দাগ দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে । আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে নন্দিনী নম্বরটা ডায়াল করলাম একবার দুবার তিন বার প্রত্যেকবারই পুরো ফোন বেজে গেল , ওপ্রান্তে কোনো সাড়া শব্দ নেই । মাথা কাজ করছিল না আমার , আর কিছু ভাবতে না পেরে দুটো হাতে মাথার চুল মুঠো করে ধরে বালির উপরে বসে পড়লাম ।


শেষ ভাগ

বালির ওপর দু হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানিনা । হঠাৎ মুখের ওপর টর্চের আলো এসে পড়তে চমকে উঠে মুখটা তুলে একটা হাত চোখের ওপরে দিয়ে হলদেটে জোরালো আলোটার দিকে দেখার চেষ্টা করলাম । এতক্ষণ হেঁটে আসার ফলেই বোধহয় হাঁটু দুটো টনটন করছিল । বালিতে দুটো হাত পেছনে ভর দিয়ে একটু কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই নন্দিনী ছুটে এলো আমার কাছে । ওর হাত দুটো ধরে কোনরকমে জিজ্ঞেস করলাম , কোথায় ছিলি তুই ? আমার গলা দিয়ে আওয়াজ প্রায় বের হচ্ছিল না । ভয় , অস্বস্তি আর টেনশনে রীতিমতো দর দর করে ঘামছি আমি তখন । নন্দিনী হাত দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল , আমিও অন্ধকারে খেয়াল না করে দলের বাকিদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের হোমস্টে তে পৌছে গেছিলাম , সরি রে , ফোন টা সাইলেন্ট করা ছিল , একটা রিং ও বুঝতে পারিনি । তারপর আমার আঙ্গুল গুলো মুঠো তে ধরে বললো , ইশ , হাত টা তো টেনশনে জমে বরফ হয়ে গেছে পুরো । ওই দেখ একটু পেছনেই আমাদের হোমস্টে । তুই আপন মনে চলতে চলতে অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে এসেছিস । নন্দিনীর উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল আমার কিন্তু আমাকে খুজতে দলের প্রায় সকলেই হাতে টর্চ এবং ল্যাম্প নিয়ে বিচের ওপর এসে উপস্থিত হয়েছে দেখে কথা বাড়ালাম না । তবে সত্যি বলতে নন্দিনি কে কাছে পেয়ে ধরে প্রাণ এসেছিল । এই প্রানের হদিশ পাওয়াটাই বোধহয় এক দশকের বেশী সময় ধরে টেনে নিয়ে চলেছে আমাদের ।

মানুষের মন বড়ই বিচিত্র বস্তু । যতক্ষণ নন্দিনীর খোঁজ পাচ্ছিলাম না চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলাম এক প্রকার । দিকবিদিক শূন্য হয়ে গিয়েছিলাম , বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ পেতে বসেছিল । এখন আবার ধীরে ধীরে সব কিছু স্বাভাবিক হতে থাকায় পেটে ছুঁচোদের আর্তনাদ শুনতে পেলাম । বেজায় খিদে পেয়েছে । পারলে সমুদ্র ,বালি , আকাশ ভরা তারা , এক কোনে মুচকি হাসা চাঁদের ফালি , লোক লস্কর , এদের হাতের লন্ঠন , টর্চ মায় এদের গায়ের জামা কাপড় পর্যন্ত কপাৎ কপাৎ করে গিলে খেতে পারি ।

রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ । বাড়িতে রান্না করা ডিনার বুফে । সকালের মতই যৎসামান্য আয়োজন কিন্তু আঙ্গুল চেটে খাওয়ার মত স্বাদ । আমি একাই প্রায় দেড় ডজন চিকেন কাবাব সাবাড় করেছি সাথে রুটি , অনিয়ন পকোড়া আর বেবিকর্ন মাঞ্চুরিয়ান । খেতে বসেও নানান গল্প জমলো । জেনি আর সুর তাদের বিভিন্ন দেশের খাওয়ার অভিজ্ঞতার পসরা খুলে বসলো। কোরিয়ার স্নেক ওয়াইন , ভিয়েতনামের স্কর্পিয়ন ফ্রাই , চায়নার ব্যাংভাজা আরো কত কি । ডিনার শেষ করে আমরা কয়েকজন মিলে সমুদ্রের ধারে একটা ছোটখাটো ক্যাম্প ফায়ারের বন্দোবস্ত করে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসলাম । গানের লড়াই , গুলতানি , মশকরা চললেও সকলেই কমবেশি পরিশ্রান্ত থাকার দরুন উদ্যমে ভাটা পড়তে লাগলো । আমাদের এনার্জি আর কাঠ শেষ হতে চলা আগুন দুটোই ক্রমে নিস্তেজ হতে শুরু করলো । তারপর আরম্ভ হল হারাধনের দশ ছেলের মত ক্যাম্পফায়ার ছেড়ে একে একে কেটে পড়া । ক্যাম্প ফায়ারে আমরা কেউই বিশেষ কিছু করিনি সুতরাং বলার মতো কোনো ঘটনা নেই । আমি মিনিট দশেক বালির ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গোনার চেষ্টা করছিলাম । খানিকক্ষণ পর চোখের পাতা খুলে রাখা দুস্কর মনে হওয়ায় চেষ্টা ছেড়ে তাঁবুর দিকে হাঁটা দিলাম ।

আকাশের উপর গোছা গোছা তারা ফুটে রয়েছে । মনে হচ্ছে কয়েকটা হীরের টুকরো হামানদিস্তায় গুঁড়ো করে মিশকালো পিচের রাস্তার উপরে ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ । ধীরে ধীরে চারপাশ শান্ত হয়ে গেল , সমুদ্রে হাওয়ার তেজ কমে আসছিল , আশেপাশের ক্যাফেগুলোতে ঝুপ ঝুপ করে লাইট বন্ধ হতে লাগলো । আমি মুখের সামনে দুবার তুড়ি মেরে একটা মস্ত বড় হাই তুলে তারাদের গুড নাইট বলে টেন্টের বাইরে উকি মারা মুখটা ভেতরে ঢুকিয়ে সামনের ত্রিপল এর পর্দাটা ফেলে দিলাম ।

শেষ ।

bottom of page