top of page

তৃতীয় চিঠি

Updated: Nov 3, 2019

#আন্দামানেরউড়োচিঠি

২৯.০৩.২০১৯ (ইঃ)


প্রিয় সবাই,

কদিন বিরতির পর ফিরে এলাম।

আন্দামান নিয়ে লিখতে বসলেই হাত নিশপিশ করে ওখানকার পরিচিত জায়গাগুলোর বিবরণ দিতে। কিন্তু না, ঐ একই জিনিস নিয়ে আমি ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করবো না। আমার লেখার বিষয় বস্তুতে চেষ্টা করি নতুনত্বের ছোঁয়া লাগাতে, সেটা ঠিক করতেই সময় লেগে যায়।

আজকের বিষয় “বা নৌ জা কপোতাক্ষ”




সেদিন অফিসে সকাল থেকেই ধুন্ধুমার কাণ্ড। মনোহর খবর এনেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছে, পৃথিবীর বাকি সব দেশ মিলে আন্দামানকে জলপথে আক্রমন করেছে। আমাদের নৌ বাহিনী প্রবল বীরত্বের সাথে সেই আক্রমন প্রতিহত করছে। শুধু তাই নয় কয়েকটা যুদ্ধ জাহাজকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে, কান ধরে হির হির করে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে “Naval Wharf” জেটিতে।

মনোহর আমাদের পিওন। পোর্টব্লেয়ারের ছেলে, যারে কয় আইল্যান্ডার। এরকম অনেক মুখরোচক খবর সে আগেও আমাকে দিয়েছে, যেমন দূরে কোথাও জাহাজ ডুবে যাওয়ায় বিদেশি সিগারেট ও ওইয়ানের পিপে নাকি ভাসতে ভাসতে অমুক দ্বীপে এসে ভিড়েছে, সবাই দলে দলে সেখানে ছুটছে কিছু লাভের আশায়। তাছাড়া রাত্রিবেলায় কোন দ্বীপে কচ্ছপ আসছে আর কারা নাকি সেগুল ধরে মচ্ছব করছে ইত্যাদি। কিন্তু আজ ও যা বলছে শুনে তো আমার আক্কেলগুড়ুম হবার জোগাড়। যাই হোক, যুদ্ধ লাগলে ভালই হয়, অফিসটা কদিন বন্ধ থাকে, গতকাল রবিবার গেছে এক ফ্রিজ বাজার আছে তাই কুছ পরোয়া নাহি, “মৎস ভাজিব খাইব সুখে”। এই সব ভাবতে ভাবতে কাজ এগুচ্ছে, নতুন চাকরি তার উপর টাকা পয়সার ব্যাপার, একবার ঐ চেয়ারে বসেছ কি ব্যাস্, কোন এক সম্মোহনী শক্তির দ্বারা হাত পা মাথা সব নিজের থেকে চালিত হয়। কোথায় যুদ্ধ কোথায় কি? সব কালো কালো মাথার ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে হাবুডুবু খাওয়ার জোগার।

বেলা তখন এগারটা হবে একজন অতি পরিচিত গ্রাহক এসে বললেন “কি রমিতবাবু জাহাজ দেখতে যান নি? জাহাজ?, আমাদের নৌ বাহিনীর জেটিতে শুনছি সারা বিশ্বের জাহাজ এসেছে”।

“এসেছে না ধরে এনেছে”- লজ্জার মাথা খেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“আরে ধরে আনবে কেন? এমনি এসেছে”

প্রত্যুত্তরে আমি বললাম “জাহাজ তো এখানে অটোর মতো ঘুরে বেড়ায়ে, সে আবার নতুন কি”- কিন্তু কৌতূহল এবার আমায় তারা করেছে। এমন সময় সায়নের ফোন, “রমিতদা আমার ব্রাঞ্চে চলে আসো, একটা হেবি জিনিস দেখাব”। সায়ন আমাদের এম.ই.এস (মিলিটারি এঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) ব্রাঞ্চএর নতুন আধিকারিক, আমাদের তিন মূর্তিতে যখন পোর্টব্লেয়ার এমনি তেঁতে আছে, তখন ব্যাঙ্ক ওকে পাঠিয়েছিল সলতেটায় আগুন লাগাতে।

“ও রমিতদা কি ভাবছো, দেখে যাও হেবি জিনিস, সারি সারি যুদ্ধ জাহাজ, এই আমাদের সামনের জেটিতেই”।

আমার তখন সব কিরকম গুবলেট পাকিয়ে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা কি? এত জাহাজ কেন এসেছে? কোথা থেকে এসেছে? সায়নকে প্রশ্ন করলাম।

“আরে যুদ্ধ জাহাজের প্রদর্শনী চলছে, গত পরশু থেকে শুরু হয়েছে। আজকেই শেষ।”

কি কাণ্ড! খাস কলকাতায় মানুষ আমি, বন্দর বা জাহাজ সেখানেও আছে কিন্তু সারা পৃথিবীর যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে প্রদর্শনী এরকম তো কখনও শুনিনি। হ্যাঁ নিজেদের দেশের জাহাজের প্রদর্শনীর কথা জানি কিন্তু এত যা দেখছি পাখি, গাছ, গাড়ী, ঘোড়া, জামা, কাপড়, ছবি সব ছেড়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ জাহাজের প্রদর্শনী। তাহলে এখন যুদ্ধ লাগলে কে সামলাবে? সব জাহাজ তো ফ্যাশন প্যারাড করতে ব্যস্ত।

কৌতূহল কিন্তু এবার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে। চোখ দুটো ছানাবড়ার মতন করে ম্যানেজারের দিকে তাকালাম। দেখি উনি মুচকি মুচকি হাসছেন। আসলে উনিও এই এলাকার বাসিন্দা। তাই এইসব জাহাজ টাহাজ ওনার ছোটবেলার থেকে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। শান্ত কণ্ঠে বললেন “যাও ঘুরে আসো, তোমরা মেন ল্যান্ডের লোক, একবার ফিরে গেলে আর কোনদিন পাবে না”। এই মেন ল্যান্ড শব্দটাও আমি ওখানেই প্রথম শিখেছি। দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে ঐ দ্বীপ ছাড়া গোটা বিশ্বটাই মেনল্যান্ড। কেউ কলকাতা গেলেও বলে মেনল্যান্ড যাচ্ছি, আমেরিকা গেলেও বলে মেনল্যান্ড যাচ্ছি। সে এক বিভ্রান্তিকর ব্যাপার। যাক গে সে কথা না হয় পরে আরেকদিন হবে।

সম্রাটকে ফোন লাগালাম, ওপাশ থেকে উত্তর এলো, “হুম! শুনেছি, তোরা যাচ্ছিস? ঠিক আছে।”

বিশুর ব্রাঞ্চ তেপান্তরের মাঠ থুরি সমুদ্র পেরিয়ে, তাই ও বাদ।

যে কয়জন অল্প বয়স্ক আধিকারিক আছে সবাই মিলে চলো “Naval Wharf” মানে নৌসেনার জেটি। সঙ্গে ছোট্ট আয়ুশ, আমার ম্যানেজারের পুত্র সন্তান।

সায়নের এটা পরিচিত জায়গা, অতএব অনুমতির ব্যবস্থা সহজেই হয়ে গেলো। গুটি গুটি পায়ে আমরা হাজির হলাম প্রকাণ্ড জেটির সামনে। পুর জায়গাটাই নৌবাহিনীর অধীনে, সাধারন মানুষের এখানে আনাগোনা নেই। তাই ভিড় মোটামুটি হালকা।

আরে এতো সত্যি যুদ্ধজাহাজের মেলা বসে গেছে। ইন্দোনেশিয়া, জাপান, পাকিস্তান, টোকিয়ো, অস্ট্রেলিয়া মানে এশিয়া মহাদেশ তো আছেই তার বাইরেও অনেক দেশ এসেছে। প্রকান্ড সব অবয়ব নিয়ে সেগুলি কালাপানির উপর ল্যাদ খাচ্ছে।


Ships at Port Blair
MILAN a multilateral naval exercise hosted by the Indian Navy under the aegis of the Andaman and Nicobar Command. Ships were from Australia, Bangladesh, Indonesia, Malaysia, Myanmar, Singapore, Sri Lanka and Thailand

গায়ের বন্দুক আর মাথার কামান গুলো দেখলে বুকটা যে ছ্যাক্ করে উঠছে না তা নয়, কিন্তু এতো মহড়া মাত্র, সত্যি তো আর যুদ্ধ লাগেনি।



আরে ওটা, ওটা কি? বাংলায় লেখা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ সত্যিই তো। প্রকান্ড শরীরের একটি জলজান, মাথায়ে নানা রকমের সব শিং মানে এ্যান্টেনা, ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখি তাতে লেখা-

বা নৌ জা কপোতাক্ষ



উরিব্বাস্ এ বেটা কোথা থেকে এসেছে। নাবিকরা সব বাংলায় কথা কইছে। আচ্ছাআআ! বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ নৌ জাহাজ, আর কপতাক্ষ হল তার নাম। বাহ! কি শোভা।

চল দেখি এর ভিতর কি আছে, পাশ থেকে সম্রাট বললো।

সম্রাট, সেও আমার মতই কাট বাঙাল। আসামে মামার বাড়ি। এমনিতে চ্যাটং চ্যাটং ইংরেজি বললে কি হবে, বাড়িতে ফোনে কথা বলার সময় পরিস্কার বোঝা যায় ওর উৎস।

বেশ, চল দেখি পোলাপানরা কি করে।আমিই বা ছাড়ি কেন।

ভিতরটা পরিপাটি করে সাজানো, একদিকে অনেকগুলো বাঙ্ক, অনেকটা ট্রেন এর সাইড স্লিপ্পারের মতন, তাতেই নাবিকদের বিশ্রামের জায়গা। নানা রকম ছোট ছোট বাতি সব জোনাকির মত জ্বলছে আর নিবছে। গোল কাচের মধ্যে কাঁটা লাগানো সব যন্ত্র, ভগবান জানে সেই দিয়ে কি মাপা হয়। নানান রকমের সামরিক অস্ত্র সস্ত্র সব থরে থরে সাজানো রয়েছে। নাবিকরা সব যথারীতি আমাদের দেখে আল্হাদে আটখানা, “আরে আসুন আসুন, আপনারা বাঙালি? এখানে আমাদের খাওয়া দাওয়ার খুব সমস্যা, মহা ফ্যাসাদে পরেছি বুঝলেন”। ওনাদের কিছু পরিচিত বাঙালি হোটেলের খোঁজ দিয়ে অনেক ভালবাসা কুড়ালাম। বেশ কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হল, কারও বাড়ি কুমিল্লায় তো কারও খুলনায়, কেউ ঢাকার তো কেউ পাবনার। কিছুক্ষণ খোস মেজাজে গপ্ল চলল। যা বোঝা গেলো এই জাহাজ নিয়ে ওনারা মোটেও যুদ্ধ করতে যান না। যে জাহাজে যুদ্ধ হয় সেই জাহাজ আরও বড়। এগুলো রক্ষী জাহাজ। জলদস্যু এবং চোরা পাচারকারী ঠেকাতে কাজে লাগে। আর কাজে লাগে নিজেদের সীমানা পাহারা দিতে। বেগতিক দেখলে বড়দা মানে বড় জাহাজকে খবর পাঠায় স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে। তারপর বড়দা এসে যা করার করেন।

কপোতাক্ষ দর্শন করে সিড়ি বেয়ে নেমে এলাম। এগুতে থাকলাম এক শান্ত কুরুক্ষেত্রর মধ্য দিয়ে।



এই চেপটা মতো জিনিসটা কি? এত জাহাজ নয়, গায়ে বন্দুক মাথায় শিং কিছুই তো নেই। তাহলে?

পাস থেকে সম্রাট বলে উঠলো “সাব-মেরিন”।

জলের উপরের যান বাহন সবই এতদিনে চিনেছি কিন্তু ইনি তো ডুব সাঁতার কেটে চলেন, তাই কখনও চোখে পরেনি ।যাক ছেলেটার কাঠের পাটাতনের মত চিৎ হয়ে শুয়ে ডিসকভারি দেখা এতদিনে কিছু কাজে লাগলো। এটা তো একবার না দেখলেই নয়।ঢুকলাম ভিতরে। এই বস্তুটির ব্যাপার স্যাপার বেশ আলাদা। অবয়বটা অনেকটা বরাহের মতন। মানে মাথা গলা বুক পেট সব একই মাপের। বেশ কয়েকটা দরজা দিয়ে অনেক গুলো ভাগে বিভক্ত, কোনোভাবে ভাবে শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যদি কোন একটি ভাগ ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে দরজা গুলো বন্ধ করে সেই ভাগটা আলাদা করে দিলেই হোল। বাকি জলজান অক্ষত থাকবে।

বাইরে বেড়িয়ে চলল একে একে বাকি জাহাজ দর্শন। খালি সিড়ি বেয়ে উঠছি আর নামছি। সঙ্গে চলছে মোবাইলে ছবি তোলা। যার যেই কামান বা বন্দুক পছন্দ তার গায়ে হেলান দিয়ে, জড়িয়ে ধরে আর যা যা সম্ভব। সেই দিনের মত অফিস মাটি করে “হাল্লা চলেছে যুদ্ধে”।



তখন সবে চাকরি জীবনের শুরু তাই দামি ক্যামেরার প্রশ্ন নেই। সব ছবিই সাধারন মানের। কিন্তু তাতে প্রানের ছোঁয়া স্পষ্ট। অনেক ছবিতে আমরা নিজেরা লাফা লাফি করছি সেগুলো তাই এখানে পোস্ট করা গেলো না। তবে আমার ব্লগে সবই থাকছে। আহামরি কিছুই নয়। সবই আমার স্মৃতি। তবে আশাকরি উপভোগ করবেন।

আজ তাহলে এই অবধি।

“আবার আসিব ফিরে ধান শিরিটির তীরে এই বাংলায়”

ইতি

রমিত সেনগুপ্ত

bottom of page