top of page

অচিন পুরীর গপ্প - পঞ্চম ও শেষ পর্ব- খাজা আবিস্কার

পঞ্চম পর্ব- খাজা আবিস্কার



আমাদের পুরী ভ্রমণ এবারের মত আজকেই শেষ। কিন্তু সব থেকে আকর্ষণীয় ও বিরল অভিজ্ঞতাটি এখনো অধরা, তার এত কাছাকাছি পৌছে গেছি ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে।

বাইকটা কালকেই ফেরত দিয়ে দিয়েছি তাই এবার এগারো নম্বর বাসটাই ভরসা। সব হিসেব মিলিয়ে যা দাঁড়িয়েছে- বারো কেজি খাজা আনতে হবে। তারমধ্যে এক কেজি আসবে দক্ষিনে, আর বাকি যাবে উত্তরে।

ঠিক বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফোন লাগালাম বাসুদেব বাবুকে, “দাদা ওই যে কাল কথা বলে আসলাম বারো কেজি খাজা লাগবে, আর আপনার কারখানা টা...”।

“আজ তো কাজ বন্ধ, কারিগর আসেনি। কখন লাগবে খাজা আপনার”

“সে তো লাগবে সন্ধ্যেবেলা কিন্তু আমি যে কাজটা ...”

“খাজা আপনাকে বেলায় দিয়ে দেব। আপনি একটার সময় আসুন”

শুধু এইটুকু বলে ফোনটা রেখে দিলেন।

মাথার ভিতরে তখন নানান রকমের নেগেটিভ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, ভুলটা আমারই। আমার প্রথম দিন থেকেই চেষ্টা করা উচিত ছিল। ইস্, আর যদি একটা দিন হাতে থাকতো ঠিক ম্যানেজ করে নিতাম, এত কাছে এসেও এমন একটা জিনিস হাতছাড়া হলো।

দাসবাবুকেও জিজ্ঞেস করেছি উনিও কখনো দেখেননি খাজা বানাতে, তবে আন্দাজ করতে পারেন এবং হ্যাঁ উনি সমানভাবে আগ্রহী বেহারা সুইটসের রসুই ঘরে ঢুকতে।

মুখ বেজার করে শ্বশুর আর জামাই দুই হাতে দুটো থলি নিয়ে কাঠফাটা রোদ্দুরে পায়ে হেঁটে চলেছি-

পৌঁছনোর আগে একবার শুধু জগন্নাথ দেব কে স্মরণ করলাম, “হে প্রভু দেখাও তোমার লীলা”।


আজ দেখি বাপ ছেলে দুজনেই আছে। গিয়ে বলতেই, কটা প্যাকেট কি কি মাপ সব জেনে নিয়ে ছেলেটি ভেতরে ঢুকে গেল খাজা পার্সেল করতে। বাসুদেব বাবু অন্যান্য খদ্দেরের সাথে ব্যস্ত, আমি পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছি কি হয়। দোকান একটু ফাঁকা হতেই আমাকে ইশারায় ডাকলেন; বললেন কারিগর এসেছে। আপনি যাবেন কারখানায়? তবে জুতো খুলে ঢুকতে হবে কিন্তু।

আমার তখন যা অবস্থা- জুতো কেন জামা কাপড় খুলতেও রাজি আছি। বাসুদেব বাবু ঠিক ঠাওর করতে পারছেন না আমার এত উৎসাহটা কিসের।

ছেলেকে বললেন “বাবু যাও ইনকো থোরা দিখা লাও হামারা কাম”।

পিছনেই কারখানা, সরু গলি দিয়ে প্রবেশ করতে হয় । শ্বশুরমশাইকে সাথে নিয়ে পিছন পিছন চললাম। তিনটি পৃথক পৃথক ঘরে কাজ চলছে। একটায় ময়দা মাখা ও বেলা। পরেরটায় মস্ত কড়াইয়ে গমগমে আঁচে সেগুলো ভাজা। সবশেষে অন্য একটি ঘরে চিনির সিরায় সেগুলি চুবানো।


ধাপে ধাপে খাজা তৈরি


ময়দা মাখা হয় কেবলমাত্র জল এবং সামান্য তেল দিয়ে। এরপর সেটাকে পাথরের উপর বেলে আবার গুটিয়ে নেওয়া হয়। সেই নলাকার বস্তুটি ছোট ছোট টুকরোতে আড়াআড়ি কেটে বানানো হয় কতগুলি কুণ্ডলী পাকানো লেচী। এই কুন্ডলীর ভিতরেই লুকিয়ে আছে খাজার আভ্যন্তরীণ স্তরের রহস্য। লেচী গুলোকে বেলে নিলেই খাজার মূল কাঠামো তৈরি। ভাঁজবার আগে অবধি আমার কিন্তু ওগুলোকে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখানো কাঁচা ফিস ফ্রাইয়ের মতই দেখতে লাগলো।


খাজার আভ্যন্তরীণ স্তরের রহস্য


খাজা বেলতে বেলতেই আলাপ হল কারিগর পূর্ণচন্দ্র পান্ডার সাথে। তার থেকেই জানলাম যে লবঙ্গের গন্ধ যোগ করা হয় চিনির সিরায়, ময়দা মাখার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। পুরীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পথচলতি সস্তার খাজা, যা কিনা নব্বই একশো টাকা দরে বিকচ্ছে, সেগুলো আসলে রঙ মিশিয়ে তেলে ভাজা, মানে ভেজিটেবিল অয়েল, এই কারনেই ওগুলোর গায়ে অতিরিক্ত লাল আভা ফুটে ওঠে। মুশকিল হচ্ছে অচিরেই তা দিয়ে তেলের গন্ধ বেরোয় এবং ক্রমে সেগুলো পাথরের আকার ধারণ করে। তখন আর খাওয়া নয় ব্যবহার করা যেতে পারে আত্মরক্ষার স্বার্থে।


মস্ত কড়াইয়ে শুদ্ধ ঘিয়ে ভাজা হচ্ছে

বেহেরা সুইটস-এর রসইঘড়ের ভিডিও

https://youtu.be/x_yzo-3rjc0


শুদ্ধ ঘিয়ে ভাজা খাজা দেখতে কিছুটা ফ্যাকাসে ধরনের হলেও এগুলি অনেক বেশি উৎকৃষ্ট মানের, দিনের পর দিন রেখে দিলেও তা দিয়ে কখনো তেলের গন্ধ বেরোয় না। অন্তত সপ্তাহ খানেক তো হেসে খেলে একই রকম থাকে।


বাম দিকে ভেজিটেবিল অয়েলে ভাজা সস্তার খাজা, ডানদিকে অপেক্ষাকৃত ফ্যাকাসে ধরনের ঘিয়ে ভাজা খাজা, ঠিক ভাজার পর, চিনির সিরায় দেওয়ার আগে- পয়সা আপনার সিদ্ধান্ত আপনার


বেহেরাদের হেঁসেলে একে একে আলাপ হল বাকি কারিগরদের সাথে। তাদের মধ্যে

সঞ্জয় রাউত, গোপিনাথ বেহেরা, ভীমসেন বেহেরা, কুণাল সাহু দীর্ঘদিন এই কাজের সাথে যুক্ত। এভাবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে ওনারা অভ্যস্ত নন, কিন্তু ঘটনার আকষ্মিকতায় যারপরনাই খুশি।


ঘটনার আকষ্মিকতায় যারপরনাই খুশি

বাসুদেব বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে রসমালাই ও রসবড়া তৃপ্তি সহকারে আস্বাদন করে ফিরতি পথে হাঁটা লাগালাম। খাজা কেনার ফলশ্রুতি হচ্ছে বাড়ি ফিরে কলিং বেলটা থুতনি দিয়ে বাজাতে হয়, কারন দুহাত তখন খাজাময়। আর এবার শুধু আসল নয় সঙ্গে আছে ডিজিটাল খাজার অ্যালবাম। আমার এবারে পুরীর সেরা প্রাপ্তি।


কথায় আছে “ওস্তাদের মার শেষ রাতে”। পুরীর ভজহরি, ওরফে সুনীলের হাতের পম্পফ্রেট মাছের ঝাল ঠিক সে কথাই বলে। গত পাঁচ দিনে সাত জন প্রাপ্ত বয়স্ক মিলে গান্ডে পিলে গিলে খাওয়া বাবদ খরচ হয়েছিল সাড়েতিন হাজারের কিছু বেশি। দুপুরের খাওয়া শেষ হতে না হতেই সময় হলো সমুদ্রকে বিদায় বার্তা জানিয়ে আসার। সদলবলে অগ্রসর হলাম মডেল বিচের দিকে। সমুদ্রকে প্রণাম জানিয়ে বাড়ি ফিরে রওনা দিলাম পুরীর রেল স্টেশনে।

পুরীকে বিদায় জানানো বেদনাদায়ক। কিন্তু তার থেকেও বেদনাদায়ক নিজের পরিবারকে বিদায় জানানো। আমার পুত্রদের এতদিনে আমায় ছাড়া থাকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, মুস্কিল হল আমার সে অভ্যাস এখনো হয়নি। চার নম্বর প্লাটফর্মে সবাই কে বসিয়ে ঝিনুক আমায় ছাড়তে এল ছয় নম্বর প্লাটফর্মে। আমার ফেরার হামসফর এক্সপ্রেস আসলে খুর্দা রোড থেকে, তাই আপাতত পুরী-দুর্গ এক্সপ্রেস করে সেই অবধি যাব। বাকিরা পুরী থেকেই দুরন্ততে ফিরবে। প্রত্যাশার থেকে অনেক বেশি প্রাপ্তি এবারের সফরে। দুঃখ একটাই, সবার সাথে একসাথে বাড়ি ফেরা হল না- তবে সেটাও নতুনত্বই বটে।


দুঃখ গুলো নাও ভাসিয়ে ধোয়াও মনের কালি। তোমায় পূজি তোমারই আধারে ছড়িয়ে দিয়ে বালি। হে সমুদ্র লহ প্রণাম।


~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~সমাপ্ত ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


76 views
bottom of page